দুবলহাটি রাজবাড়ী নওগাঁ – ইতিহাস, যাতায়াত ও ভ্রমণ গাইড
দুবলহাটি রাজবাড়ীর ইতিহাস
বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার সদর উপজেলা থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে দুবলহাটি ইউনিয়নে অবস্থিত এই রাজবাড়ীটি । প্রায় দুই শতাব্দীর পুরোনো এই স্থাপনাটি তৎকালীন রাজশাহী বিভাগের এক প্রভাবশালী জমিদার বংশের স্মৃতি বহন করে চলেছে ।
প্রতিষ্ঠা ও
বিস্তার
দুবলহাটি জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জগতরাম নামের একজন লবণ ব্যবসায়ী, যিনি বাণিজ্য উপলক্ষে এই অঞ্চলে আসেন এবং বিল অঞ্চলের ইজারা নিয়ে ধীরে ধীরে প্রচুর জমির মালিক হন ।
কথিত আছে, এই অঞ্চলের জমিদাররা উৎপাদিত ফসলের পরিবর্তে মোগল নবাবকে বার্ষিক ২২ কাহন কৈ মাছ রাজস্ব হিসেবে দিতেন । এ কারণেই জমিদারদের এই অঞ্চলটি 'ভূমা মহল' নামে পরিচিতি লাভ করে ।
১৭৯৩ সালে কৃষ্ণনাথ রায় চৌধুরী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় দুবলহাটির জমিদার ছিলেন । তবে এই রাজবাড়ীর সবচেয়ে বেশি উন্নতি এবং বিস্তার ঘটে তাঁর নাতি রাজা হরনাথ রায় চৌধুরীর সময়ে (১৮৫৩ সালে দায়িত্ব গ্রহণ) ।
· উপাধি লাভ: জনহিতকর কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৫ সালে হরনাথ রায় চৌধুরীকে 'রাজা' এবং ১৮৭৭ সালে 'রাজা বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত করে ।
· সাম্রাজ্যের বিস্তার: তাঁর সময়ে জমিদারি রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর, ফরিদপুর এবং সিলেটের কিছু অংশে পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।
· জনহিতকর কাজ: তিনি ১৮৬৪ সালে একটি অবৈতনিক নিম্ন মাধ্যমিক ইংরেজি স্কুল (যা পরে রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়) প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিক্ষাবিস্তারে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন । সাধারণ মানুষের জলকষ্ট মেটাতে পুকুরও খনন করেছিলেন ।
· স্থাপত্য: ২.৪৫ থেকে ৫ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত দ্বিতল এই সুবিশাল রাজপ্রাসাদটি ইন্দো-ইউরোপীয় বা ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি । একসময় এতে নাটমহল, কাচারি, অন্দরমহল, রন্ধনশালা, চারটি বৃহৎ পুকুর এবং প্রায় একশোরও বেশি কক্ষ ছিল ।
১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপ হওয়ার পর রাজা হরনাথ রায়ের বংশধররা ভারতে চলে যান । এরপর থেকেই অযত্ন-অবহেলায় বিশাল এই অট্টালিকাটি আজ প্রায় ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে, যদিও বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে রয়েছে ।
দুবলহাটি রাজবাড়ী কীভাবে যাবেন?
দুবলহাটি রাজবাড়ী যেতে হলে আপনাকে প্রথমে নওগাঁ জেলা শহরে পৌঁছাতে হবে ।
১. ঢাকা
থেকে
নওগাঁ:
· বাসে: ঢাকার গাবতলী, মহাখালী বা কল্যাণপুর থেকে সরাসরি নওগাঁগামী এসি/নন-এসি বাস (যেমন: শ্যামলী, হানিফ, এস আর) পাবেন । ভাড়া সাধারণত ৭০০-১২০০ টাকা ।
· ট্রেনে: ঢাকা থেকে সরাসরি নওগাঁ যাওয়া যায় না । প্রথমে ট্রেনে সান্তাহার জংশন (নওগাঁ জেলার কাছাকাছি) বা রাজশাহী স্টেশনে নামতে হবে । এরপর লোকাল ট্রেন, বাস বা অন্য কোনো পরিবহনে নওগাঁ শহরে আসতে হবে ।
২. নওগাঁ
শহর
থেকে
দুবলহাটি
রাজবাড়ী:
নওগাঁ শহর থেকে দুবলহাটি রাজবাড়ীর দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার ।
· অটো বা সিএনজি রিকশা: নওগাঁ শহরের বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড বা গোস্তহাটীর মোড় থেকে সরাসরি অটো বা সিএনজি রিকশা রিজার্ভ করে দুবলহাটি রাজবাড়ী যেতে পারবেন । রিজার্ভ ভাড়া দূরত্ব এবং সময়ভেদে ২০০-৪০০ টাকা হতে পারে ।
· লোকাল ট্রান্সপোর্ট: বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রথমে হাপানিয়া পর্যন্ত যেতে হবে । হাপানিয়া থেকে ভ্যান বা অটো রিকশায় রাজবাড়ী পৌঁছানো যায় ।
দুবলহাটি রাজবাড়ীর কোথায় থাকবেন?
দুবলহাটি রাজবাড়ী মূলত নওগাঁ শহর থেকে সামান্য দূরে একটি ইউনিয়ন এলাকায় অবস্থিত । রাজবাড়ীর একদম পাশে থাকার ব্যবস্থা নেই । তাই আপনাকে নওগাঁ জেলা শহরেই থাকতে হবে ।
নওগাঁ শহরে বিভিন্ন মানের কিছু হোটেল ও গেস্টহাউস রয়েছে । আপনার বাজেট অনুযায়ী বেছে নিতে পারেন:
· হোটেল:
o হোটেল প্লাজা (Hotel Plaza)
o হোটেল ফারিয়াল (Hotel Farihal)
o হোটেল অবকাশ (Hotel Obokash)
o হোটেল মিতালী (Hotel Mitali)
o মল্লিকা ইন ( Mollika In)
· সরকারি আবাসন:
ভ্রমণ টিপস:
· একদিনের ভ্রমণ: রাজবাড়ীটি নওগাঁ শহর থেকে খুব কাছে হওয়ায় সকালে গিয়ে দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসা সম্ভব । তাই নওগাঁ শহরে থেকে দিনের বেলা ভ্রমণ করাই সবচেয়ে সুবিধাজনক ।
· নিরাপত্তা: রাজবাড়ীটি বর্তমানে ভগ্নপ্রায় ও পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে । ভেতরে সিঁড়ি, ছাদ এবং অন্যান্য অংশ ঝুঁকিপূর্ণ । তাই ভ্রমণের সময় অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করুন ।
দুবলহাটি রাজবাড়ী শুধুমাত্র একটি স্থাপনা নয়, এটি এক গৌরবময় ইতিহাসের
নীরব সাক্ষী । অতীতের সেই জমকালো দিনগুলোর ছাপ এখনো এর ইটে ইটে
বিদ্যমান ।
সেরা ভ্রমণ সময় (Best Time to Visit)
দুবলহাটি রাজবাড়ীতে বছরের যেকোন দিন যেকোন সময় যাওয়া যায় তবে নভেম্বর থেকে
মার্চ
মাস
পর্যন্ত সময়টি
দুবলহাটি রাজবাড়ী ভ্রমণের জন্য
সবচেয়ে
উপযুক্ত । এসময়
আবহাওয়া মনোরম
থাকে
এবং
রাজবাড়ীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ
করা
যায় ।
নওগাঁ জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ:
দুবলহাটি রাজবাড়ী ভ্রমণের পাশাপাশি আশেপাশে আরও কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা যায়, যেমনঃ
- · পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
- · কুসুম্বা মসজিদ
- · বলিহার রাজবাড়ী
- · জগদ্দল বিহার
- · পতিসর কাচারিবাড়ি
- · দিব্যক জয়স্তম্ভ
- · আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান
- · রক্তদহ বিল
- · হাঁসাইগাড়ী বিল
📸
ভ্রমণ টিপস:
- রাজবাড়ীর
ভিতরে ঢোকার আগে স্থানীয় অনুমতি নিন ।
- ঐতিহাসিক
স্থাপনাগুলিতে হাত না দিয়ে শুধু দর্শন উপভোগ করুন ।
- সকাল বা বিকেলে ছবি তুললে আলো বেশি সুন্দর থাকে ।
- পরিবেশ পরিচ্ছন্ন
রাখুন, প্লাস্টিক ব্যবহার পরিহার করুন ।
👉 আপনি কি কখনো দুবলহাটি রাজবাড়ী ভ্রমণ করেছেন? আপনার অভিজ্ঞতা নিচে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না!
👉 যদি আপনি এই স্থানে যেতে চান, কোন অংশটি আপনাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করে – ইতিহাস, স্থাপত্য নাকি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য?
মনের রঙের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url