ভাষা বিভ্রাট - Bengali Short Story । Moner Rong Website

ভাষা বিভ্রাট - Bengali Short Story । Moner Rong Website Bangla Choto Golpo ছোট গল্প choto golpo book choto golpo rabindranath Bangla love SMS Collection

ভাষা বিভ্রাট - Bengali Short Story


ভাষা বিভ্রাট - Bengali Short Story


বিয়ের পর এই প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি বরের সঙ্গে । আমার বড় হওয়া শহরে৷ শ্বশুরবাড়ি গ্রামে । সেখানকার আঞ্চলিক ভাষা সম্পর্কেও আমি অবগত নই । শুনেছি তারা বরিশালের ভাষায়ই কথা বলেন ।
গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির সামনে পা রাখতেই সবার চেঁচামেচি শুরু, 'হক্কোলে আইয়া দেইক্কা যা জাইদ্যার বউ আইছে ।'
আমি জাহিদের দিকে তাকিয়ে বললাম, 'হক্কোলে?'
জাহিদ হেসে বললো, 'সকলে আরকি সবাই ।'
'আইয়া আর দেইক্কা?'
'আইয়া হলো এসে আর দেইক্কা মানে দেখে । গ্রামের মানুষজন, বুঝোই তো! কথাবার্তা আঞ্চলিক হওয়াটাই স্বাভাবিক ।'
আমি নরম স্বরে বললাম, 'আচ্ছা । কিন্তু জাইদ্যা! এটা আবার কে?'
জাহিদ হা হা করে হেসে উঠে বললো, 'জাহিদ থেকে জাহিদ্যা সেখান থেকে জাইদ্যা ।'
মুচকি হেসে বললাম, 'আচ্ছা । বুঝলাম যে তোমাকে এখানে জাইদ্যা নামে ডাকা হয় ।'
জাহিদ আবার হেসে উঠলো ।
আমরা সামনে এগোতেই একদল বাচ্চারা আমাদের আশেপাশে ঘিরে হাঁটতে লাগলো আর বারবার আমাকে দেখতে থাকলো । ওদের সবার মুখে হাসি । সেই হাসিতে ওদের আন্তরিকতার ছাপ লেগে আছে ।
বাসায় ঢুকে শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম করতেই শাশুড়ি মা বললেন, 'থাউক, অইছে লাগবে না । হ্যার চাইয়া তুমি মোর বোহে আও ।'
আমি জাহিদের দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকাতেই ও এসে বললো, 'মা তোমাকে বলেছে, তাকে জড়িয়ে ধরার কথা ।'
আমি মুচকি হেসে শাশুড়ি মা'কে জড়িয়ে ধরলাম । 
আশেপাশের লোকজনের কথপোকথন কানে ভেসে আসতে থাকলো । 
'বউগ্যা তো ম্যালা ভাল্ চিনায় ।'
'হয় ব্যাডা । একছের ভাল্ দেহায় ।'
'চোউক দুগ্গা বড় বড়,  নাকগোউও লোম্ফা আছে, চামরাডা দুদের নাহান ধবধইব্যা সাদা ।'
'ক্যা মোগো জাইদ্যারে কী কম ভালো দেহায় নাহি?'
'না। হেইয়াও ঠিক কতা কইছো ।'
তাদের কথোপকথন চলছে । আমি শুধু সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে যাচ্ছি । আসলে আমি আদৌও বুঝতেছি না তারা আমার প্রশংসা করছে নাকি গালি দিচ্ছে । 
ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম । 
শাশুড়ি মা বললেন, 'বউমা বাইগুনদ্যা আশের আন্ডা রানছি হেইয়া আগে দিমু, না নাহোইলের দুইদ্যা চিঙ্গোইর মাছ ঝোল হরছি হেইয়া দিমু?'
আমি কিছু বলার আগেই জাহিদ বললো, 'মা ও হাঁসের ডিম, বেগুন, নারিকেলের দুধ, চিংড়ি মাছ সবই খায়। তুমি দাও যেটা তোমার ইচ্ছা ।'
পরদিন বিকেলে জাহিদের চাচাতো বোন মুন্নির সাথে ওদের বাসার পিছনের বাগানে ঘুরতে গেলাম এমন সময় জাহিদের এক চাচি এসে বললেন, 'ঐ মুন্নি, দেহিস আবার মাতার উফরে য্যান টরহি না পড়ে, নাহোইল গাছের নিচে খারাইস না । আর বাগানের মইদ্যে দাউর, গ্যারা-গোরা, নাহোইলের বাইলতা, সুবারির খোল পাইলে টোহাইয়া লইয়া আইস । ক্যালা গাছের ফ্যাতরাইদ্যা রানতে গেলে খালি ধোমা অয়, ঐদ্যা জ্বাল ধরান যায় নাহি!'
উত্তরে মুন্নি বললো, 'আচ্ছা পাইলে টোহাইয়া লইয়া আমু আনে ।'
আমি হা হয়ে তাদের দু'জনের কথা গিলে যাচ্ছি । কোনো একটা লাইনও আমার বোধগম্য হচ্ছে না । জাহিদটাও সারাদিন আমার কাছে থাকে না । এখানে সেখানে তার কাজ থাকে। ওর'ই বা কী দোষ! প্রায় ছয় মাস পর বাড়িতে এসেছে কাজ তো থাকতেই পারে ।
আমাদের বিয়েটা দুই পরিবারের অমতে সবাইকে না জানিয়েই হয়েছিলো । জাহিদ ভালো একটা চাকুরি করে, বিয়ের পর আমরা ভালো আছি, এটা দেখে আমার বাবা-মা মেনে নিয়েছেন দুই মাস হলো । জাহিদও তার পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে । যার কারণেই জাহিদ আমাকে নিয়ে বাড়িতে আসার সাহস করেছে । 
সবাই সবকিছু বুঝলেও আমি এখানকার ভাষা কিছুতেই বুঝতে পারছি না । প্লে স্টোরে এবং গুগলে খুঁজতে লাগলাম বরিশালের ভাষাটা শুদ্ধ বাংলায় অনুবাদ করার কোনো উপায় আছে কী না । কিন্তু কোনো অ্যাপ্স বা কোনো উপায়ই খুঁজে পেলাম না ।
কী আর করা! যা আছে কপালে । শেষমেশ কপালের উপরেই নির্ভর হলাম । ভাষা না জানি, তাদের অঙ্গভঙ্গি, বলার ধরণ দেখে তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারব যে তারা আসলে কী বোঝাতে চাইছেন । এই যেমন ভাষা না জেনেও তামিল, কোরিয়ান, তুর্কি, চাইনিজ মুভি দেখে কাহিনী বুঝতে পারি । ওভাবেই বোঝার চেষ্টা চালাব । 
এসব ভেবে নিজেকে কিছুটা স্বস্তি দিতে সক্ষম হই ।
আমার শাশুড়ি তার মতো এক বয়স্ক মহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বললেন, 'বউমা, হোনো। ইনি অইলো তোমার খালা হাউরি । মোর হাইজ্যা বুইন । জাইদ্যারে তো ল্যাংডাকাল থেইক্কা পাইল্যা পুইষ্যা হে'ই বড় বানাইছে ।'
আমি তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মনে মনে মিলাতে লাগলাম - 
'আমার খালা হাউরি । হাউরি মানে কোনো একটা সম্পর্কের নাম । সে আমার শাশুড়ির হাইজ্যা বুইন । বুইন হলো বোন । মানে শাশুড়ির বোন হয় সম্পর্কে আর আমার হয় খালা শাশুড়ি । কিন্তু হাইজ্যাটা কী! এটা মনে হয় খালা শাশুড়ি বলার পরে বলতে হয় ।'
এতটুকু মিলাতে পেরে মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম । জাইদ্যা মানে আমার স্বামীকে সে কোন কাল থেকে কী বানিয়েছে সেটা আপাতত না বুঝলেও চলবে । তাই এখন শাশুড়ির বলা শেষ লাইন বোঝার চেয়ে খালা শাশুড়ির সঙ্গে কুশল বিনিময় করাটা অতীব জরুরি ।
আমি মুখখানা হাসি হাসি করে বললাম, 'খালা শাশুড়ি হাইজ্যা ভালো আছেন আপনি?'
সে ধমকের সুরে উত্তর দিলো, 'ঐ মাতারি হাইজ্যা কইতে কইছে কেডা তোমারে? আর এরোহোম খালা শা-শু-ড়ি না কইয়া খালাম্মা কইলেই তো অয় । হোনতেও ভালো হুনায় । তোমাগো শহরের মাইয়া-পোলাগো এই এক বদইভ্যাস কেডা কী অয় কইতে পারে না!'
আমি বুঝতে পারলাম তিনি রেগে গেছেন । ভালো কিছু হয়তো বলেননি । আমি মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম ।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমরা কয় ভাই বুইন?'
'জ্বী । দুই বোন ।'
'তুমি ডাঙ্গর?'
'না। আমরা কেউ ডাঙ্গর না তো । আমার নাম হীমা আর ছোট বোনের নাম সীমা ।'
তিনি হেসে বললেন, 'ডাঙ্গর বোঝো নাই? এইডা অইছে তোমাগো দুইজনের মইদ্যে বয়সে কেডা বড় হেইয়া ।'
আমি হেসে বললাম, 'এবার বুঝেছি । বোনের মধ্যে আমি বড় ।'
আলাপ শেষ হলে তিনি চলে গেলেন । আমার ছোট ননদ রান্নাঘর থেকে বেশ কতক্ষণ ধরে জোর গলায় শাশুড়ি মা'কে ডেকে চলছে । আমি উঠে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম । ততক্ষণে শাশুড়ি মাও চলে এসেছেন রান্নাঘরে ।
তিনি রাগত্ব স্বরে ননদকে বললেন, 'এ ছেমরি ভোলাইছো ক্যা? মরোইন্না চিউক্কোর চিরহাইতেছো । অইছে কী? মরছে কেডা?'
ননদ জবাব দিলো, 'ভোলাইছি কী খালি খালি নাহি! কইছি ডাইলে নুন দেছো না দেবা?'
'এ ছেমরি। হেইয়া হোনতে কী মোরে ভোলান লাগে! তুই পাইলাইদ্যা উরহিতে এট্টু ডাইল উডাইয়া মোহে দিয়া দ্যাকলেই তো পারতি । মুই উমাইন্না মুরহাডারে আদার খাওয়াইতে গ্যালহাম । এলহা এলহা কত কাম হরা যায়, হেই পিন্নে তোরে ওশ্বাঘরে বওয়াইয়া থুইয়া গ্যালাম ।'
'তুমি আও তাততারি । মুই আর বইতে পারমু না ।'
'বইয়া বইয়া চুলায় দাউর দিবি আর জ্বাল ঠেলবি । হ্যাতে এত কষ্ট কী?'
আমি চুপচাপ তাদের কথা শুনে যাচ্ছিলাম । কিন্তু কিছুই বুঝতে সমর্থ হলাম না । সব কথা আমার মাথার উপর দিয়ে গেল । জাহিদ থাকলেও কিছু কথা মাথার ভিতরে ঢুকতো । 
সন্ধ্যায় জাহিদের বড় ভাইয়ের ছোট্ট ছেলে-মেয়েগুলোকে গল্প শোনাচ্ছিলাম । গল্প বলা শেষ হলে আমি ওদেরকে পাঁচটা ফলের ও ফুলের নাম বলতে বললাম ।
একজন বেশ আনন্দ সহকারে বললো, 'হবরি, কাডাল, ক্যালা, কোমলা, কোম্বা । ভরা গান্দা ফুল, খয়রি গান্দা ফুল, তারা গান্দা ফুল, হাপলা ফুল, কোমলি ফুল ।'
আমি কিছু বোঝার ও বলার আগেই অন্যজন উঠে বললো, 'মুই পাঁচটা পশু আর পক্কির নাম কই?'
আমি বললাম, 'হ্যাঁ বলো ।'
'কুত্তা, বিলই, উন্দুর, খাড়াশ, মইষ । আর পক্কি অইলো হালিক, কাউয়া, কইতোর, অইলদ্যা পক্কি, বুলবুইল্যা ।'
আমি হাসি দিয়ে চমৎকার বলে চুপ হয়ে গেলাম । এসব অদ্ভুদ ফল, ফুল, পশু, পাখি বাংলাদেশে আছে আর আমি চিনি না, ভেবে আফসোস হচ্ছে । 
সকালে নাস্তা করে বাজারের উদ্দেশ্যে চলে গেলো জাহিদ । আমি একা একা বেশ কতক্ষণ ধরে বসে আছি । এখানকার মানুষের ভাষা না বুঝলেও তাদের আতিথেয়তা আর আন্তরিকতা আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। তাদের সহজ সরল মুখগুলো আমার খুব ভালো লাগে ।
পাশের বাসার এক ভাবী এসে পাশে বসলে একাকীত্ব ঘুচে গেলো । তিনি আমাকে আস্তে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, 'কাইব্যানে কয় টাহা ল্যাকছেলেন?'
আমি মাথা নেড়ে বললাম, 'কই না তো! কোনো টাকা লিখিনি তো ।'
তিনি অবাক হয়ে বললেন, 'আসসোভাহানাল্লাহ্! হেইলে বিয়া ক্যামনে অইলে?'
'বিয়ে হয়েছে তো । আমি তো জাহিদের বউ ।'
'হেইয়াই তো জিগাইলাম ।'
'কিন্তু আমি তো বুঝিনি ।'
তিনি বিরক্তির ভঙ্গিতে চলে গেলেন । 
জাহিদের বড় ভাইয়ের স্ত্রী আরকি বড় ভাবী এসে বললেন, 'হীমা লও নাইয়া আই । দুহারে খাওয়ার ওক্ত অইয়া গ্যাছে । বেইন্যাহাল অইতে একছের কাম আর কাম । খাইয়া এট্টু হুমু ।'
আমি শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, 'আচ্ছা ।'
পুকুরে গোসল করার সময় বড় ভাবী জিজ্ঞেস করলেন, 'হাতোর জানো?'
আমি হ্যাঁ বলবো নাকি না বলবো বুঝছিলাম না ৷ অনেক ভাবনা চিন্তা শেষে বললাম, 'এটা দেখতে কেমন?'
পুকুরে গোসল করতে আসা সবাই হা হা করে হেসে দিলেন । আর আমি চুপ হয়ে গেলাম ।
বিকেলে বাড়ির পাশের বিলের ধারে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে সবুজে ঘেরা গ্রামের ছবি তুলছিলাম । এমন সময় এক বয়স্ক লোক এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'ও মনু, তুমি কেডা? তোমার বাড়ি কোম্মে?'
আমি বুদ্ধি করে বললাম, 'চাচা, আমি জাইদ্যার বউ।'
তিনি হেসে বললেন, 'তুমি মোগো জাইদ্যার বউ! মাশাল্লাহ্! আল্লায় ভালো রাহুক তোমাগো ।'
আমি হেসে তার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে এলাম ।
এতদিন আঞ্চলিক ভাষার যাতাকলে পিষে আমিও অনেকটাই রপ্ত করে ফেলেছি, এমন একটা চিন্তা যখন আমার মাথায় বসবাস করতে শুরু করলো ঠিক তখন আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেলো ।
চলে যাওয়ার সময় আমার শ্বশুর আমাকে বললেন, 'পেরথোম ফির আইলা, ক্যামন কী লাগজে জানি না, এইয়ার পর যহন মন চায় তহন আবা । আর আইলে ম্যালাদিনের লইগ্যা আবা । তোমার লগে হইরা তোমাগো বাড়ির হক্কুলডিরে লইয়া আবা । বোজজো মা?'
জাহিদ উত্তর দেওয়ার আগেই আমি হাসি দিয়ে বললাম, আচ্ছা বাবা । আপনিও পেরথোম ফির হক্কুলডিরে লইয়া খুলনা আবা । ম্যালাদিনের লইগ্যা পেরথোম ফির যহন মন চায় তহন আবা এইয়ার পর ক্যামন কী লাগজে জানি না ।'
এই প্রথমবার আমি তাদের আঞ্চলিক ভাষায় এতগুলো কথা একসঙ্গে বললাম । যাওয়ার সময় তো বলতেই হয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে খুশি খুশি চোখে পাশে তাকাতেই দেখি জাহিদ মুখ চেপে ধরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে । আমার শাশুড়ির চোখ মাথার উপর, শ্বশুর থ হয়ে তাকিয়ে আছেন, বাকি সবাই মুখ চেপে হেসেই যাচ্ছেন । 
আমি লজ্জা কাটাতে বলে উঠলাম, 'মুই আসলে বোজদে পারিনি, কী কইতে গিয়া কী বলে ফেলেছি । পেরথোম ফির বলেছি তো ।'
এবার আর জাহিদের হাসি যেন থামেই না ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url