বিষ - Poison । Bengali Short Story

বিষ - Poison । Bengali Short Story


বিষে বোতল থেকে একচামচ বিষ নিয়ে বেশ ঠান্ডা মাথায় বিষটুকু গ্লাসে ঢেলেই এক রহস্যজনক হাসি দিল সিয়াম । এই হাসির ভিতরে যে এক ভয়ঙ্কর রূপ লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে বাকি থাকবেনা কারোরই । নিলাকে পেতে হলে যে তাকে এই কাজটি করতেই হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না ।
ধীরপায়ে সিয়াম দুধের গ্লাসটি নিয়ে নিজেদের বেডরুমের দিকে রওনা দিলো । এই মুহূর্তে মিমি অফিসের ফাইল ঘাটাঘাটিতে ব্যস্ত থাকে সেটা সিয়ামের অজানা নয় ।


মিমির সাথে সিয়ামের বিয়েটা হয়েছিল বেশ ঝাকঝমকপূর্ণভাবেই । বিয়ের আগে মেয়েটিকে কেবল একবারই দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর আর সেই প্রথম দেখাতেই মিমিকে সে নিজের হৃদয়ঘরের সম্পূর্ণ অংশটিই ছেড়ে দিয়েছিল । মিমিরও যে তাকে পছন্দ হয়নি তাও কিন্তু নয় কেননা একাধারে সিয়াম যেমনি সুদর্শন একজন পুরুষ তেমনি একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাও বটে । বিয়ের পর থেকে তাঁদের দুজনের সুখের কোনো কমতি ছিল না এমনকি মিমির সবকথাই সিয়াম রাখার চেষ্টা করতো । তাইতো বিয়ের ছয়মাসের মাথায় যখন মিমি ওর স্বামীর নিকট চাকরির আবদার করে বসে তখন সিয়াম নিজের স্ত্রীর কথা আর ফেলতে পারেনি ।
তবে এতো কিছুর মাঝেও সিয়ামের আলাদা নারীদের প্রতি একটু আসক্তি ছিল । তাইতো মিমির অজান্তেই সে অজস্র মেয়েদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে রুমডেট অবধি নিয়ে গেছে কিন্তু সে মিমির সামনে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যে তাঁর মতো নিরীহ প্রাণী এই জগতে মনে হয় একটিও নেই । আর মিমি মেয়েটিও না কেমন যেন খুব বোকা, সে এখনো পর্যন্ত বুঝতেই পারেনি যে সিয়াম তাঁর অনুপস্থিতিতে অজস্র মেয়েদের সাথে একান্তে প্রণয়ের গল্পগুজব করে ।


ইদানিং ইলমা সিয়ামকে বেশ চাপ দিচ্ছে যে সে যেন মিমির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে তাকে তাঁর বউ হিসেবে ঘরে তুলে আনে । কিন্তু এই কথাটি ইলমা যতটাই সহজভাবে বলেছে সিয়ামের নিকট এই কাজটি করা তার চেয়েও বহু কঠিন কাজ । কেননা সম্পর্ক বিচ্ছেদের ক্ষেত্রেতো অন্ততঃপক্ষে একটি উসীলার প্রয়োজন কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো মিমি মেয়েটি এতোটাই নমনীয় মনের অধিকারী যে বিয়ের পর ওর সাথে সিয়ামের কোনো বিষয় নিয়ে একবারও কথা কাটাকাটি হয়নি ।



সিয়াম দরজাটা আস্তে করে ঠেলে দিয়েই নিজেদের বেডরুমে প্রবেশ করলো । ঐদিকে কম্পিউটারের সামনে বসে মিমি একমনে কাজ করছে । নিজের সামনে গ্লাসে দুধ নিয়ে স্বামীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিমি অবাক হলোনা । কারণ গত কয়েকদিন যাবৎ এভাবে নিজ স্ত্রীকে দুধ খাওয়ানোটা যেন সিয়ামের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে । মুচকি হেসে মিমি দুধের গ্লাসটি হাতে নিয়েই বললো,

- ব্যপার কি? ইদানিং দেখছি আমার প্রতি তোমার কেয়ার বেশ বেড়ে গেছে?

কথাটি মজার ছলে বললেও সিয়াম কিছুটা চমকে উঠলো বোধহয় । পরক্ষণেই মুখোমন্ডলটিকে স্বাভাবিক করে বললো,

- স্বামী হিসেবে স্ত্রীর একটু আধটু কেয়ার নেওয়াতো অস্বাভাবিক কিছু না তাইনাহ? তুমি আগে দুধটুকু খেয়ে নাও ।


মিমি মুখে কিঞ্চিত হাসির রেখা টেনে বললো,

- এখন খাবোনা । আগে রাতের খাবারটা সেড়ে নেই তারপর খাবো । আজ তোমার প্রিয় ভুনা খিচুড়ি আর খাসির মাংস রান্না করেছি । টেবিলে চলো! দুজন একসাথে খাবো ।

মিমির কথায় সিয়ামের চোখেমুখে বিরক্তির আভা ফুটে উঠলেও সে দুধ খাওয়ার জন্য আর ওকে জোর করতে পারলোনা । তবুও সে মনে মনে বলছে,

- আজ যেভাবেই হোক তোকে আমি বিষ খাওয়াবোই ।


খাবার টেবিলে সিয়ামের সামনে গরম গরম খিঁচুড়ি আর খাসির মাংস নিয়ে বসে আছে মিমি । সে সিয়ামের প্লেটে খিঁচুড়ি আর মাংস ঢেলে দিচ্ছে কিন্তু এদিকে তাঁর যেন খাওয়ার কোনো নামই নেই ।

অজানা কৌতূহলে সিয়াম জিজ্ঞেস করলো,

- কি হলো? তুমি খেতে বসছো না যে?

মিমি পুনরায় মুচকে হেসে বলে,

- আমি পরে খাবো তুমি এখন খাও ।

- সেটা আবার হয় নাকি? দুজন একসাথেই খাবো, তুমিও প্লেট নিয়ে বসে পরো ।

এবার মিমি চোখেমুখে বিরক্তির রেশ টেনে বললো,

- আরে তুমি খাওতো । আমার অনেক কাজ পরে আছে । আজ কাজের বুয়াটাও কাজ করতে আসেনি । সকল থালাবাসন নোংরা হয়ে আছে । তুমি এখন খাও, আমি বরং থালাবাসনগুলো ধুয়ে এবং সবকিছু গুছগাছ করে একবারেই খেতে বসবো ।

নিজ স্ত্রীর কথায় সিয়াম আর কথা না বাড়িয়ে মাংসের ঝোল মিশিয়ে খিঁচুড়ি খেতে শুরু করলো । নিঃসন্দেহে মিমির হাতের রান্না অন্যসব রমণীদের থেকেও ভালো সেটা সিয়ামের চেটেপুটে খাওয়া দেখলে যে কেউই বলবে । তবে খাবার এতো মজাদার হলেও সে খিঁচুড়ির মধ্যে কেমন যেন এক উদ্ভট গন্ধ আবিষ্কার করে । যদিও এই গন্ধে খাবারের স্বাধে একটুও ভাটা পরেনি তবে গন্ধটা শুকলে কেমন যেন মাথাটা গুলিয়ে আসে ।

এসব ব্যপারে সে আর মিমিকে জেরা করলো না কারণ এমনিতেই মেয়েটি সারাদিন অফিস করে এসে এতো কষ্ট করে তাঁর প্রিয় খাবার রান্না করেছে আর এর উপর যদি এসব নিয়ে সে দোষ ধরে তাহলে নিশ্চই মিমি কষ্ট পাবে ।

সিয়ামের বুকে এবং পেটের ভিতর কেমন যেন ঝাল মরিচের মতো জ্বালাপোড়া করছে
। মনে হচ্ছে কেউ বোধহয় তাঁর পেটে একবোতল মরিচ ঢেলে দিয়েছে । জ্বালাপোড়ার মাত্রাটা যেন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে । সহ্য করতে না পেরে সিয়াম চিৎকার দিয়ে মিমিকে ডেকে উঠলো । কিন্তু মিমির রান্নাঘর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না । কাতড়াতে কাতড়াতে একপর্যায়ে সিয়ামের মুখ থেকে সাদা ফেনা বেড়িয়ে আসে এবং কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সে মেঝেতে লুটিয়ে পরে ।


আধঘন্টা পর...
মিমি এইমুহূর্তে বসে আছে সিয়ামের নিথর দেহের ঠিক পাশেই । যেখানে তাঁর অঝোর ধারায় স্বামী হারানোর আর্তনাদ করার কথা ছিল সেখানে সে এই মুহূর্তে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে । সে জানে এখন সিয়ামের লাশটা কিভাবে রেখে জনসাধারণের মাঝে হার্ট এ্যাটাক বলে চালিয়ে দিতে হবে? টেবিল থেকে ফোনটা নিয়েই মিমি আরিফের কাছে কল দিল । এই ছেলেটির সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছে খুব বেশিদিন নয় কেবল দু'মাস । আরিফ আর মিমি একই অফিসে কাজ করে আর সেই সুবাধেই তাঁদের মাঝে এক প্রণয়ের গল্প শুরু হয়ে যায় । আর সিয়ামকে মেরে ফেলার প্ল্যানটি স্বয়ং আরিফই তাকে দিয়েছিল । কেননা সিয়ামকে যদি কোনোভাবে দুনিয়া থেকে সরানো যায় তাহলে ওর সহায় সম্পত্তির অনেকাংশের অংশীদারই হবে মিমি তাছাড়া সরকারীভাবে যে ভাতা পাওয়ার কথা সেটাতো বাদই দিলাম ।

অপরপাশ থেকে কলটি রিসিভ করই আরিফ বেশ উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-কি ব্যপার সবকিছু ঠিকঠাক করেছোতো?

-হ্যাঁ! এখন ওর লাশ বিছানায় পরে আছে ।

-আচ্ছা বাকিটা যেভাবে যেভাবে বলেছি সেভাবে করে রেখো যাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ না থাকে ।
-আচ্ছা ঠিক আছে ।

কলটি কেঁটে দিতেই মিমির চোখ যায় টেবিলে রাখা সেই দুধের গ্লাসটির দিকে । মুহূর্তেই তাঁর চোখবেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে । যত যাই হোক সিয়াম যে বিয়ের পর থেকে এতোগুলো দিন তাঁর কাছে এক শ্রেষ্ঠ স্বামীর ভূমিকায় ছিল সেটা মিমির অস্বীকার করার সুযোগ নেই । ধীরপায়ে সে গ্লাসটির দিকে এগিয়ে গিয়েই সেটি হাতে গুঁজে নেয় । সে যদিও তাঁর স্বামীর খুনি কিন্তু এইমুহূর্তে এই গ্লাসের দুধটুকু খেয়ে সে সিয়ামের শেষ আবদারটুকু রক্ষা করতে চায় ।


মিমি বিছানায় বসে পেটে ব্যাথার যন্ত্রনায় ছটফট করছে, কিছুক্ষণ পর ওর মুখ দিয়ে রক্ত ছিটকে আসে । পাশে থাকা পানির জগ থেকে পানি খাওয়ার দরুন পেটের যন্ত্রনা যেন আরো একটু বাড়লো ।


একদিক থেকে ইলমা সিয়ামের নাম্বারে একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে অপরদিকে আরিফ মিমির নাম্বারে দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক কল । কিন্তু দুঃখের বিষয় এপাশ থেকে কেউই তাঁদের কল রিসিভ করছে না ।

পরদিন সিয়ামের বাড়িতে সাংবাদিক এবং পুলিশের হট্টগোলে এক বিরূপ পরিবেশের সৃষ্টি হয় । মিডিয়ায় খবর প্রকাশ হচ্ছে যে,

''পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রী স্বামীকে বিষ খাইয়ে হত্যার পর স্ত্রীর পুনরায় বিষ খেয়ে আত্মহত্যা ।''
কিন্তু তাঁরা আদৌ যানে না যে ওরা একে অপরের ফাঁদে পরে এইমুহূর্তে উভয়েই নরকের পথে ধাবিত হচ্ছে । এটাইতো কাম্য ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url