প্রেম তুমি - Prem Tumi । মিষ্টি প্রেমের গল্প - Season-2 - Episode: 09
প্রেম তুমি
ফাবিহা নওশীন
সিজন - ২
পর্বঃ ০৯
"বিচ্ছেদের যন্ত্রণার চেয়ে অধিক যন্ত্রণা পাবে যখন জানবে আমি তোমাকে সন্তান সুখ দিতে ব্যর্থ। কাউকে আজীবন অসুখী করার চেয়ে সাময়িক কষ্ট দেওয়া শ্রেয়।"
দর্শনের মাথা ঘুরছে। এই কথার মানে কী? দর্শন তারিখ দেখল। এই তো মাসখানেক আগের লেখা। দর্শন পরের পাতা উল্টালো। পরের পাতায় লেখা আছে, "আমি নিয়তি মেনে নিয়েছি। তবুও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুকের ভেতর প্রখর যন্ত্রণা টের পাই। আর চোখে উষ্ণ অশ্রু কণা। কেন? হয়তো আজও ভালোবাসি তাই।"
দর্শন এসির মধ্যেও দরদর করে ঘামছে। আবারও পাতা উল্টালো আর প্রথম লেখাটা পড়ল। এর মানে কী দ্বারায়? সন্তান সুখ দিতে ব্যর্থ মানে? ব্যর্থ কেন?
এরই মধ্যে খট শব্দে দরজা খুলে অর্ষা বেরিয়ে এক। হঠাৎ দর্শনকে দেখে চমকে উঠে। আতংকিত মুখে ওর দিকে তাকায়। তারপর চোখ যায় ওর হাতের ডায়েরিটার দিকে। ডায়েরির দিকে চোখ যেতেই অর্ষার পিলে চমকে উঠে। ঢোক গিলে দর্শনের থমথমে মুখের দিকে তাকায়। এতে ও আরো ভয় পেয়ে যায়। অজানা একটা আতংক মনে জেঁকে বসে।
অর্ষা ওর হাত থেকে ডায়েরিটা কেড়ে নিয়ে বলল,
"এগুলো কী ধরনের অভ্যাস? পারমিশন ছাড়া কারো পার্সোনাল জিনিসে হাত দিতে নেই জানো না?"
দর্শন ওর দু বাহু চেপে ধরে বলল,
"সন্তান সুখ দিতে ব্যর্থ এর মানে কী? কি লোকাচ্ছ তুমি আমার থেকে? আমাকে সব খুলে বলো।"
অর্ষা যা ভয় পেয়েছিল তাই হলো। দর্শন সব পড়ে ফেলেছে। এখন কি বলবে? মনে হচ্ছে বুকের ভেতর দগদগে ঘায়ে নতুন করে আঁচড় পড়েছে। ভীষণ জ্বলছে। অর্ষা ওকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ততা দেখিয়ে ডায়েরিটা ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বলল,
"এমনি। তেমন কিছু না। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি।"
অর্ষা অগোছালো ভাবে বলে গেল। কিন্তু দর্শন ওর কথা মানার পাত্র না।
দর্শন ওর চোখের দিকে চেয়ে বলল,
"তাহলে চোখে পানি টলমল করছে কেন? কেন উপচে পড়তে চাইছে? কেন কষ্ট পাচ্ছো? প্লিজ সত্যিটা বলো। আমার টেনশন হচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।"
অর্ষা ধরা পড়ে গেছে। দর্শন সত্যিই কষ্ট পাচ্ছে। যে কষ্টটা ওকে দিতে চায়নি তাই হচ্ছে। এতদিন নিজেকে এই জন্য লুকিয়ে গেছে।
"দর্শন, দেখো কোন সমস্যা নেই। অল ওকে। তোমার বোনের এনগেজমেন্ট চলছে আর তুমি এখানে। তোমার যাওয়া উচিত।"
দর্শন মিনতি করে বলল,
"আমি কি এখন তোমার পায়ে পড়ব? যদি তাই চাও তবে তাতেও রাজি আছি। তবুও আর আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। আমার আর ধৈর্য নেই।"
অর্ষা চুপ করে আছে। দুজনেই নীরব। নিরবতা ভেঙে দর্শন বলল,
"তোমার কোন প্রব্লেম হয়েছে? তুমি কি মা হতে.... দর্শনের গলা আঁটকে আসছে।
অর্ষা আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না। চিৎকার করে বলল,
" না, আমি পারব না। আমি মা হতে পারব না। ওই এক্সিডেন্টে আমি সব হারিয়েছি। ডাক্তার বলেছে আমার মা হওয়ার চান্স খুব কম।"
অর্ষা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। দর্শনের বুকে গিয়ে বিঁধল ওর চিৎকার। ও ধপ করে বসে পড়ল। মাথা ঝিমঝিম করছে। কি থেকে কি হয়ে গেল। অর্ষা মা হতে পারবে না এটা মানতে পারছে না। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অর্ষার মতো চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। অর্ষাকেও সান্তনা দিতে পারছে না। কি বলে সান্তনা দিবে? কোন মুখে দিবে?
দর্শনের মোবাইল বেজে উঠল। দিশা কল করেছে। চোখের পানি মুছে কল রিসিভ করল।
"ভাইয়া, তুমি কোথায়? আমার এনগেজমেন্ট পার্টি রেখে কোথায় চলে গেছো? আয়ান আমাকে আংটি পরাবে। যেখানে আছো দশ মিনিটের মধ্যে চলে এসো।"
দিশার কথায় রাগের বহিঃপ্রকাশ। দর্শন অর্ষার দিকে একবার তাকাল। ও তখনও কেঁদেই চলেছে।
"আসছি।"
বলে দর্শন কল কেটে দিল। ফ্লোর থেকে উঠে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। হাঁটছে আর শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছছে।
স্বপ্নটা কেন চুরমার হয়ে গেল? কেন বারবার হারাচ্ছি? আর কত হারাব? আর কত হারানো বাকি আছে?
~~~~~
অর্পা রুশানকে কল করেছে। ধরবে না ধরবে না করেও কল রিসিভ করল।
তবে আশ্চর্যের বিষয় অর্পা নিজের কথা না বলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
"দর্শনের কী হয়েছে?"
রুশান পালটা প্রশ্ন করল,
"কী হয়েছে?"
"তোমাকে কল করেনি?"
"না তো।"
"কিছুক্ষণ আগে আমাকে কল করেছিল। ও কাঁদছিল। কান্না জড়িত কন্ঠে বলল আমি রোজ রোজ আর কত সত্যের মুখোমুখি হব? আর কত যন্ত্রণা পাব? আর কতবার মরব?
ওর কণ্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছিল বারবার। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে। উত্তর দিল না। কল কেটে দিল। তারপর আর রিসিভ করেনি।"
রুশানও বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।
"আচ্ছা আমি দেখছি কি করা যায়। ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করব। যদি না পারি ওর বাসায় যাব।"
"আমাকে জানিও। আমিও যাব ওর বাসায়।"
"আচ্ছা।"
"ওকে। রাখছি।"
অর্পা কল কেটে দিল। বাড়তি একটা কথা বলল না।
~~~
অর্পা আর রুশান দর্শনের বাসায় গিয়ে বসে আছে। দর্শন এখনো হসপিটাল থেকে ফিরেনি। বাসায় ওর মা আর বোন। রুশান আর অর্পা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। দর্শন বাড়িতে এসে ওদের দেখে চমকে গেল। অর্পা আর রুশান ওকে সরাসরি ওর রুমে নিয়ে গেল। অর্পা দরজা লক করে দিল।
"দর্শন, তোর কি হয়েছে? দিশার এনগেজমেন্ট অবধি তো সব ঠিক ছিল। হঠাৎ কী হলো?"
দর্শন ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নিচু করে রাখল। রুশান ওকে চুপ দেখে বলল,
"চুপ করে থাকিস না৷ চুপ করে থাকলে কোন প্রব্লেম সলভ হবে না। শেয়ার কর সবাই মিলে একটা সল্যুশন বের করব।"
দর্শন মাথা উচু করে বলতে লাগল,
"এনগেজমেন্টের দিন আমি একটা সত্য জানতে পেরেছি।"
রুশান জিজ্ঞেস করল,
"কোন সত্য?"
"অর্ষা, কখনো মা হতে পারবে না।"
রুশান আর অর্পা দুজনেই এক সাথে বিস্ময় নিয়ে বলল,
"হোয়াট? কি বলছিস তুই?"
"হ্যা, সেই এক্সিডেন্টে ও মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে।"
অর্পা আর রুশান দুজনেই ওর কথা শুনে স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ।
দর্শন ডুকরে কেঁদে উঠল।
"আর কত পরীক্ষা দেব আমি? যে মেয়েটা একটা এক্সিডেন্টে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে তাকে এতগুলো বছর সবাই ঘৃণা করে এসেছে। একা একা কত কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। ওর পাশে কেউ ছিল না। আমিও না। আমি আর কত অপরাধী হব?"
রুশান বলল,
"এতে তোর কোন দোষ নেই। নিজেকে অপরাধী ভাবিস না।"
"আমি নিজেকে নির্দোষ ভাবতে পারছি না। আমার নিজেকে অপরাধী লাগছে। আমার জন্য ও এতকিছু হারিয়েছে,এত কষ্ট পেয়েছে। আমি ওর জন্য কিচ্ছু করতে পারিনি।"
অর্পা ওর পাশে গিয়ে বসল,
"এসব জানার পরেও ওকে ভালোবাসবি?"
দর্শন অবাক দৃষ্টিতে অর্পার দিকে তাকাল। অর্পা এটা কেমন প্রশ্ন করল? তবে প্রশ্নটা কঠিন। এই প্রশ্নের সহজ একটা উত্তর আছে ওর কাছে। রুশানও ওর প্রশ্নে হতবাক।
"ভালোবাসার সাথে ওর মা না হওয়ার কী সম্পর্ক? আমি ওকে ভালোবাসি আর সব পরিস্থিতিতে বাসব।"
অর্পা মৃদু হেসে উত্তর দিল,
"তাহলে আর কি? ইউ নো, বর্তমানে কত পদ্ধতি আছে বাচ্চা নেওয়ার। ওকে গ্রহণ কর। তোর ভালোবাসা দিয়ে ওকে জয় কর। ওকে এত ভালো রাখবি যে একদিন অতীতের সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে যাবে। চোখের পানি মুছে ফেল। ওর কাছে যা, ওর এখন তোকে খুব প্রয়োজন। প্রয়োজনের সময় যদি তোকে না পায় তবে ওর জীবনে তোর যে বিশেষ জায়গা যেটা তুচ্ছ মনে হবে। তোর আর কোন মূল্য থাকবে না ওর জীবনে।"
"কিন্তু ও যে আমাকে গ্রহণ করতেই চায় না।"
"শোন, কোনদিন তো তোকে ভালোবেসেছে। সে ভালোবাসা থেকে তোর প্রতি ওর একটা দূর্বলতা রয়েই গেছে। কতবার ফেরাবে? ফেরাতে ফেরাতে ক্লান্ত হয়ে যাবে, মন গলে যাবে। তুই শুধু চেষ্টা করে যা।"
দর্শন যেন হারানো মনোবল ফিরে পেয়েছে। মৃদু হেসে বলল,
"থ্যাংকস। আমি তোদের কথায় সাহস ও শক্তি পাচ্ছি। আমি ওর ভালোবাসা পাবই।"
অর্পা মৃদু হেসে ওর কাধে চাপট দিল। রুশান ফ্যালফ্যাল করে ওদের দেখছে। ওদের নয় অর্পাকে দেখছে। দর্শন ফ্রেশ হতে যেতেই অর্পার চোখ পড়ে রুশানের দিকে। রুশান অপলক ওর দিকে চেয়ে আছে। অর্পা ঘনঘন পলক ফেলে আবার ওর দিকে তাকাল।
"কিছু বলবে?"
রুশান মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।
"আই লাভ ইউ।"
রুশানের মুখে আই লাভ ইউ শুনে অর্পা থমকে গেল।
অর্ষা দর্শনের সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে গিয়েছে। ওর আসার একটাই উদ্দেশ্য সেটা হচ্ছে দর্শন কি বলে সেটা জানার। সেদিনের পর আর দর্শনের সাথে দেখা হয়নি। দর্শন হসপিটাল থেকে সরাসরি আসবে। অর্ষা আগে আগে এসে বসে আছে। বুঝতে পারছে না দর্শন কেন ডেকেছে। কিছু বলার থাকলে মোবাইলে বলতে পারত, এভাবে ডাকার কি আছে। এসব ভাবতে ভাবতে দেখল ডাক্তার সাহেব চলে এসেছে। চোখের চশমাটা খুলে অর্ষার দিকে এগিয়ে এল। অনেক দিন পর আবার দর্শনের চোখে চশমা দেখতে পেল। দর্শন অর্ষাকে দেখে এগিয়ে এল। চেয়ার টেনে বসে ওকে এক পলক দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
"কেমন আছো?"
অর্ষা দর্শনকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
"ভালো।"
দর্শন মৃদু হাসল। তারপর অর্ষার চোখের দিকে চেয়ে বলল,
"তুমি কি সত্যিই অর্ষা?"
"মানে?"
"এই যে ভালো আছো তাই। আমাকে ছাড়া এত ভালো কি করে থাকো? আগে তো একটা দিন ভালো কাটতো না আমাকে ছাড়া। ভালোবাসা বদলে গেলো কী করে?"
অর্ষা ওর প্রশ্নে নির্বাক। বলতে ইচ্ছে করছে সব কিছুই বদলে গেছে। না চাইলেও পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে ভালো থাকতে হয়। ভালো না থেকে উপায় নেই। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না।
দর্শন ওর কাছ থেকে উত্তর আশাও করেনি।
পকেটে থেকে ছোট একটা বক্স বের করল। বক্সটা টেবিলের উপরে রাখল। অর্ষা আড়চোখে ওর কাজ দেখছে। বক্সটা দেখে এর ভেতরে কি আছে কিংবা কেন বের করেছে এর কারণ উদঘাটন করতে পারল না। তাই চুপ করে দেখেও না দেখার ভান করে রইল। দর্শন বক্সটা টেবিলের উপরে রেখে চুপচাপ বসে আছে।
অর্ষার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই প্রশ্ন করল,
"আমাকে ডেকেছো কেন?"
দর্শন বাকা হাসল। তারপর মাথা চুলকে বলল,
"গুড কোশ্চেন। এতক্ষণে একটা কাজের কথা বলেছো।"
দর্শনের এমন রহস্য কিংবা ভনিতা করে কথা বলা অর্ষার মোটেও ভালো ঠেকছে না।
দর্শন বক্সটা খুলে অর্ষার সামনে ধরল। অর্ষা বক্সের ভেতরে একটা রিং জ্বলজ্বল করতে দেখে দর্শনের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল। ওর চোখেমুখে বিস্ময়, প্রশ্ন দেখে দর্শন আর ভনিতা করল না। সরাসরি বলল,
"উইল ইউ মেরি মি?"
ওর প্রস্তাবে অর্ষার ভেতরে তোলপাড় হতে লাগল। ইচ্ছে করছে বলতে ইয়েস কিন্তু ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে না। বারবার কে যেন বলছে আবেগে ভেসে যাস না। অর্ষার চোখের কোণে পানি জমেছে। নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,
"তোমার মাথা ঠিক আছে? সব জেনেও কি করে এমন প্রস্তাব দিচ্ছো?"
"সব জেনে মানে কি? যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে দু সেকেন্ডর মাথায় মরে যাচ্ছো। জীবন অনিশ্চিত আর খুব ছোট। এই জীবনে সুখী হতে বড় কিছু প্রয়োজন হয় না আর না ভেবেচিন্তে, ঘেটে-ঘুটে সব হয়। আর হ্যা আমার মাথা একদম ঠিক আছে। আমি সুস্থ, স্বাভাবিকভাবেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।"
"দেখো দর্শন, বয়সটা পাগলামির না। তুমি আগে থেকেই যথেষ্ট ম্যাচুউর। আশা করি এখন আরো ম্যাচুউর হয়েছো। তাই আবেগে ভেসে যেও না প্লিজ। তুমি অপরাধবোধে ভুগছো তাই তো? এখানে তোমার কোন অপরাধ নেই আমি বলছি। আমার সাথে যা হয়েছে সেটা আমার ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে দ্যাটস ইট। এসবে আর নিজেকে জড়িও না। যদি আমার কথা বলো তো বলব আমি ভালো আছি৷ আমি আমার লাইফ নিজের পছন্দ মতো গুছিয়ে রেখেছি। কোন কিছুর প্রয়োজন নেই আমার। আর না কমতি আছে। বিয়ে, সংসার এসবে আমার কোন আসক্তি নেই। আমি যে লাইফ লিড করছি সেটা আমার জন্য একদম পারফেক্ট। তাই প্লিজ আমার জন্য চিন্তা করো না। নিজের লাইফে ফোকাস করো। আর ভালো থাকো। আর হ্যা কখনো, কোনদিন আবেগের বশে কোন সিদ্ধান্ত নিও না।"
দর্শনের কান জ্বলে যাচ্ছিল। রাগে গা রি রি করছে।
"হয়েছে তোমার? তোমার লেকচার শুনতে আমি আসিনি৷ এমন দু'চার লাইনের লেকচার আমিও দিতে জানি। বড় লায়েক হয়ে গেছো? ভালো জব, ভালো স্যালারি ব্যাস মাথায় উঠে গেছো? বড় ম্যাচুউর হয়ে গেছো? আবেগ আর বাস্তবতা আমাকে শেখাচ্ছো? এসব ড্রামা আমার সামনে একদম করবে না। মাথায় রক্ত উঠে যায়। সব সময় তোমার এই লেকচার শুনতে আমার ভালো লাগে না। আমি আজ এসেছি তোমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করতে আর তুমি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছো? আচ্ছা অর্ষা তোমার কি মনে হয় আমার জ্ঞান বুদ্ধি কিছুই নেই?"
"আমি সেটা বলছি না। বলছি আমার নিজের কথা। আমি বিয়েতে ইন্টারেস্টেড নই।"
"কেন নও?"
"কারণ আমি অপারগ। আমি মা হতে পারব না। তাই আমি বিয়ে করতে চাই না।"
অর্ষা দু হাত জোড় করল দর্শনের সামনে। চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি পড়ল।
"প্লিজ আমার পিছু ছেড়ে দেও। ভালো লাগে না আমার।"
দর্শন চেঁচিয়ে উঠল,
"কীসের অপারগতা? এত না লায়েক হয়েছো? এত না পড়াশোনা করেছো? তুমি না আধুনিকা? তাহলে তোমার চিন্তাভাবনা এত চিপ কেন? কোন মানুষই পারফেক্ট হয় না। এর মানে এই না সে জীবনের কাছ থেকে কিছুই পাবে না। এর মানে এই না সে সারাজীবন কেঁদে যাবে। সুখী হওয়ার অধিকার প্রত্যেক মানুষের আছে। তোমার আছে, আমারও আছে।"
রেস্টুরেন্টে আশেপাশের সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। অর্ষা দর্শনের নাম উচ্চারণ করে আশেপাশে তাকাল৷ দর্শন দেখে অনেকেই ওদের দিকে চেয়ে আছে।
তাই তাড়া দেখিয়ে বলল,
"উঠ, আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি।"
দর্শন জোর করে অর্ষাকে নিয়ে যাচ্ছে।
"কোথায় যাচ্ছি আমরা?"
দর্শন কিছু না বলে ওকে নিয়ে বের হয়ে গেল। লিফটে চড়ে ছাদে গেল। ছাদে গিয়ে অর্ষার হাত ছেড়ে দিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাদটা আলো করে রেখেছে গুটি কয়েক আলোক বাতি।
"দর্শন, আমাকে এখানে কেন আনলে?"
দর্শনের এমন ব্যবহারে অর্ষা আতংকিত হয়ে আছে। দর্শনের চোখে-মুখে রাগ, জেদ খেলা করছে।
দর্শন পাইচারি করে নিজেকে কন্ট্রোল করছে।
তারপর ওর সামনে এসে দাঁড়াল।
"দেখো, সুখী হওয়ার জন্য, ভালো থাকার জন্য দুটো মানুষের ভালোবাসাই যথেষ্ট। ভালোবাসা থাকলে আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।"
দর্শন ওর দু গালে হাত রাখল। ওর হাত নিয়ে নিজের গালে বুলালো। অর্ষার অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে।
"কোন কিছু ফিল করতে পারছো অর্ষা?"
দর্শন ওর আঙুলের ফাঁকে আঙুল রেখে ওর হাতের পাতায় ঠোঁট ছুয়ালো। দমবন্ধ হয়ে আসছে অর্ষার। তাই দ্রুত হাত সরিয়ে নিল।
দর্শন কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে ফের প্রশ্ন করল,
"না-কি এখন আর ভালোবাসো না?"
অর্ষা ওর প্রশ্নে চমকে ওর দিকে তাকাল। দর্শন জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু কোন জবাব দিতে পারছে না। ওর কাছে কোন জবাব না পেয়ে মলিন হাসল। তারপর ধীর গলায় বলল,
"ফাইন!"
দর্শন ফাইন বলে পেছাতে লাগল। ওর চোখ অর্ষার চোখেই আঁটকে আছে। এভাবে কেন পিছিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। ছাদের কিনারা ঘেঁষে যেতেই অর্ষার হুশ হয়। ওর বুক কেঁপে উঠল। দর্শন ছাদের কর্ণারে কেন যাচ্ছে। কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে না তো?
"দর্শন, স্টপ! থামো বলছি।"
অর্ষা ওর দিকে দৌঁড়ে যাচ্ছে। দর্শন থামছেই না। ওর চোখে মুখে কিছু খেলা করছে। ম্লান মুখটায় কিঞ্চিৎ হাসি খেলা করছে। অদ্ভুত সে হাসি।
দর্শন রেলিঙ ধরে দাঁড়ায়। নিচের দিকে তাকায়। পুরো দুনিয়া তুচ্ছ লাগছে ঠিক সেদিনের মতো। সেই সকালটার মতো। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। এতগুলো বছর কম কষ্ট পায়নি। আজও পেল আর বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতেও পাবে। দর্শন রেলিঙ ধরে এক পা রেলিঙে তুলে। অর্ষা পেছনে থেকে ওকে ধরে ফেলে।
"কী করছো তুমি? পাগল হয়ে গেছো? আবার একই ভুল কেন করছো?"
অর্ষা ওকে টেনে রেলিঙের কাছ থেকে সরিয়ে আনে।
দর্শন চিৎকার করে বলল,
"কী করব আমি? এভাবে আমি বাঁচতে পারব না। পারব না আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে।"
অর্ষা মেঝেতে বসে পড়ল। বসে বসে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
"নিজেকে অনেক কষ্টে শক্ত করেছি। কেন বারবার দূর্বল করে দেও?"
অর্ষা কেঁদেই চলেছে। ওর কান্না থামছেই না। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। মনের সমস্ত কষ্টকে বৃষ্টি হয়ে ঝড়াবে। দর্শন হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসল। ওর মাথাটা নিজের প্রশস্ত বুকে চেপে ধরল।
"কেন গোপনে কষ্ট পাও? কেন আমাকে কষ্ট দেও? তুমি আমার হলে আমার আর কিচ্ছু চাই না।"
অর্ষা ঘর্মাক্ত মুখটা তুলে বলল,
"কিন্তু তুমি যদি কখনো বদলে যাও?"
"আমি কখনো বদলাব না। প্রমিস। আমি শীঘ্রই দুই পরিবারের সাথে কথা বলব। যত দ্রুত সম্ভব আমি তোমাকে আমার করে নিতে চাই।"
~~~~
অর্ষার ঘুম হচ্ছে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে শুধু ছটফট করছে। দর্শনকে তো ধরা দিয়ে এসেছে। কিন্তু দর্শনের পরিবার? তারা কি বলবে? তারা কি ওকে মেনে নিবে? যদি মেনে না নেয়? যদি সময়, পরিস্থিতি আর বাবা-মায়ের প্ররোচনায় দর্শন বদলে যায়? তাহলে কি সহ্য করতে পারবে?
এসব প্রশ্ন অর্ষার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
সকাল সকাল দর্শন ওকে কল করেছে। তখনও বিছানা ছাড়েনি। ঘুম ভাঙতেই ওর কথা মনে পড়ল। ওর মনটা বেশ ফুরফুরে। কল দিয়েই জিজ্ঞেস করল,
"হ্যালো, অর্ষা কি করো?"
অর্ষা গম্ভীরমুখে পাল্টা প্রশ্ন করল,
"এত সকালে?"
এই প্রশ্নে দর্শন চুপসে গেল।
"কেন সকাল সকাল কল দিতে পারি না? "
অর্ষার মনটা অশান্ত হয়ে আছে। রাতে ঘুম হয়নি। তাই মন মেজাজ দুটোই খারাপ। তবুও নিজেকে সামলে বলল,
"না মানে পারো তো। কিন্তু তোমাকে হসপিটালে যেতে হবে তাই বললাম আর কি।"
দর্শনের কাছে অর্ষার কন্ঠস্বর অন্য রকম লাগছে। নিশ্চয়ই কিছু নিয়ে ভাবছে। মনের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব চলছে। দর্শন এসব আঁচ করতে পেরে কিছুটা ডিস্টার্ব হলো। অর্ষা কি নিয়ে ভাবছে? সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাবে না তো? আবার দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে না তো? বহু বছর আগে যেভাবে পালিয়েছিল সেভাবে আবার পালাবে না তো?
দর্শন কোন রকমে কল কেটে দিল। সিদ্ধান্ত নিল অর্ষা কিছু করার আগেই ওকে নিজের করে নিবে। ওকে কোন সুযোগ দেবে না।
অর্ষার অফিস শেষে দর্শন ওর জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। অর্ষা ওকে দেখে অবাক হলো। কিছু না জানিয়ে হুট করে চলে এল যে।
অর্ষাকে গাড়িতে বসতে বলল। অর্ষা গাড়িতে ওঠে
বসতেই দর্শন সরাসরি বলল,
"আজকে আমরা বিয়ে করব।"
চলবে?