প্রেম তুমি - Prem Tumi । মিষ্টি প্রেমের গল্প - Season-2 - Episode: 08

 

প্রেম তুমি - Prem Tumi । মিষ্টি প্রেমের গল্প - Season-2 - Episode: 08

প্রেম তুমি

ফাবিহা নওশীন

সিজন - ২

পর্বঃ ০৮


দিশা ভার্সিটি থেকে নিজের রুমে ঢুকতেই দরজায় কড়া নড়ল। ব্যাগটা রেখে ঘরের এসির রিমোট খুঁজছিল। না পেয়ে মেজাজ তুঙ্গে। তখনই দর্শন ওর রুমে ঢুকল। 

দিশা রিমোট খোজা বাদ দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। 

"আমি মা'কে সব জানিয়েছি। মা'কে রাজি করানোর জন্য নিজের সমস্ত নলেজ কাজে লাগিয়েছি। সে রাজি।"


"আর বাবা?"


"বাবাও রাজি। আয়ান সম্পর্কে এমন পাম মেরেছি যে কিছুতেই এ পাত্র হাতছাড়া করবে না। একদম বিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হবে। আমি বলেছি, আমি ছেলের সব খোঁজ খবর নিয়েছি। খুব ভালো ফ্যামিলি।"


"বিয়ে!"


"হ্যা, বিয়ে। অবাক হচ্ছিস কেন?"


"কিন্তু তুমি না বললে যে অন্তত পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করা উচিত। এখন শুধু..... 


" মত পালটে ফেলেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের ডেট ফাইনাল করব।"


"হঠাৎ?"

দিশা ওর আগ্রহ দেখে অবাক হচ্ছে। ওর চেয়ে ওর ভাইয়ের আগ্রহ বেশি দেখছে। তাহলে কি দর্শন জেনে গেছে খালাতো বোনের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য পুরো পরিবার অস্থির? দিশার মনে এই শঙ্কা বাসা বাঁধল। 


দর্শন বোনের চোখে বিস্ময় দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, 

"তেমন কিছু না। ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে চাইছি না। ভাই, তো বোনের ভালোই চাই। তুই আর আপত্তি করিস না। আয়ানের সাথে কথা বল। জিজ্ঞেস কর যে ওরা কবে আসবে আমাদের বাড়িতে। সেদিনই না-হয় বিয়ের পাকা কথা হবে।"

দর্শন তাড়া দেখিয়ে চলে গেল। দিশা এসির রিমোট খোজা বাদ দিয়ে আয়ানকে কল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সবাই এত সহজে মেনে নিবে ভাবতেই পারেনি। আয়ানের সাথে ওর বিয়ে হবে উফফ!


আয়ান খুশিতে নাচতে নাচতে অর্ষাকে খবরটা দিল। অর্ষা খুব খুশি হলো তবে মনে একটা ভয় বাসা বাঁধল। দর্শন ওর কাছাকাছি চলে আসছে। ও সেদিন যা করেছে এভাবে যদি লিমিট ক্রস করতে থাকে তবে বিষয়টা কোন দিকে মোড় নিবে জানা নেই। 


~~~~~


অর্পা, রুশানের উপর ক্ষেপেছে। রুশান ওকে পাত্তা দিচ্ছে না। যে কি-না এক সময় ওর পেছনে ঘুরত সে এখন ওকে ঘোরাচ্ছে। তাই গিয়ে সরাসরি ওর কলার চেপে ধরল। আচমকা কলার চেপে ধরায় রুশান হকচকিয়ে গেল। চারদিকে চেয়ে বলল, 

"কী করছো? সবাই দেখছে তো।"


"দেখুক সবাই। এই কয় বছরে তুমি বড় লায়েক হয়ে গেছো। আমাকে দেখছোই না। এদিকে তোমার জন্য আমি বিদেশে যাওয়া ক্যান্সেল করে দিলাম।"


"আমি তোমাকে একবারও বলেছি সেটা করতে?"


"না-ও তো বলোনি।"


"আমার বলা না বলায় কি আসে যায়?"


অর্পা চিৎকার করে বলল, 

"আসে যায় ষ্টুপিড। যদি না আসতো যেত তবে এভাবে তোমার পেছনে ঘুরতাম না। সব ফাইনাল হওয়ার পরেও বিদেশে যাওয়া ক্যান্সেল করতাম না।"


"আরে, কেন করেছো? তোমার ড্রিম তুমি পূরণ করো। আমি চাই তোমার ড্রিম পূরণ হোক। গো।"


অর্পা রুশানের চোখে চোখ রেখে দু'গালে হাত রেখে বলল, 

"আমার ড্রিম তুমি।"


রুশান ওর হাত ঝারা দিয়ে সরিয়ে বলল,

"যারা আমাকে দুই পয়সা দাম দেয় না আমি তাদের এক পয়সা দাম দেই না। তোমার যেখানে যাওয়ার যাও, যা খুশি করো আমাকে প্লিজ বিরক্ত করো না।"

রুশান ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে চলে গেল। অর্পা ওকে পেছন থেকে বারবার ডাকল। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে লাগল। কিন্তু রুশান একবারের জন্য ওর দিকে তাকাল না। নিজের মতো চলে গেল।। ওর চোখগুলো লাল। লাল চোখগুলো হঠাৎ ছলছলে রুপ ধারণ করেছে। 


আয়ান রেডি হয়ে অর্ষার রুমে গেল। অর্ষা বিরস মুখে সন্ধ্যার আকাশের দিকে চেয়ে আছে। ওকে দেখে আয়ানের মেজাজ বিগড়ে গেল। 

"অর্ষা, তুই এভাবে বসে আছিস কেন? এখনো রেডি হোস নি?"


অর্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে নিচু স্বরে বলল, 

"ভাইয়া, শরীর ভালো নেই। আমি যেতে পারব না। তোমরা যাও।"


আয়ান ওর বিছানায় বসে বলল,

"শরীর খারাপ? শরীরের আবার কী হলো? জ্বর না-কি?"


"তেমন কিছু না। এমনি ভালো লাগছে না।"


"ঠিক আছে আমি ওদের কল করে জানিয়ে দিচ্ছি আমরা আজ আসতে পারছি না। অন্য দিন আসব৷"


অর্ষা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। 

"আরে না। কি বলছো? আমার জন্য এত সুন্দর একটা দিন কেন নষ্ট হবে? তোমরা চলে যাও।"


"তুই না গেলে আমি যাব না। তুই যেদিন যেতে পারবি সেদিনই যাব। কোন সমস্যা নাই।"

আয়ান ওর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। অর্ষা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, হায় আল্লাহ! 


অর্ষাসহ আয়ানের বাবা-মা সবাই সন্ধ্যে বেলায় দিশার বাড়িতে উপস্থিত হলো। অর্ষা বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই ইতস্তত করছে। কখনো ভাবেনি দর্শনের বাড়িতে আসবে। আজ শুধু বাধ্য হয়ে আয়ানের জন্য আসতে হলো। কেমন গুটিয়ে আছে ও। অর্ষাকে দিশা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো বাড়ি দেখাল৷ একটা ঘরে ঢুকে অর্ষার চোখ আঁটকে গেল। এই ঘরটা দর্শন ছাড়া আর কারো হতে পারে না। দর্শন ছোট থেকেই গোছালো, পরিপাটি। এই ঘরটা দর্শনের। অর্ষার স্পষ্ট মনে আছে আগের ঘরের ডেকোরেশন এমনই ছিল। 

"এটা ভাইয়ার ঘর।"


অর্ষা মুখ ফস্কে বলে ফেললো, 

"তোমার ভাইয়া কোথায়?"

নিজের বোকামির জন্য জিভে কামড় দিয়ে বিরবির করে কি জানি বলল। 


দিশা কিছু মনে করল না। ও স্বাভাবিকভাবেই বলল,

"ভাইয়ার আজ হসপিটালের জয়েনিং ডেট। এভাবে তো অনেক দিন তো গেল। আজ বাবা অনেক রাগারাগি করেছে। তাই.... 


দর্শন বাড়িতে নেই, ওকে একটু দেখতে পাবে না এই বিষয়টা হঠাৎ ওকে বেশ পোড়াচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। অর্ষা গিয়ে বসার ঘরে খালা - খালুর কাছে বসল। দিশার মা ডিনার তৈরি করতে ব্যস্ত আর ওর বাবা আয়ানের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। কিছুক্ষণ পরে দর্শন বাড়িতে আসল। হঠাৎ দর্শনকে দেখে অর্ষার মনে ভালো লাগা ছুয়ে গেল৷ আয়ান দর্শনকে কি জানি ইশারা করল। অর্ষা কিছুই বুঝতে পারল না। দর্শন মুচকি হেসে অর্ষার দিকে একবার চেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। 


ফ্ল্যাশব্যাক। দুদিন আগে। 

দর্শন আয়ানকে কল করে একটা রেস্টুরেন্টে ডাকে। আয়ান নার্ভাস মনে দর্শনের সাথে দেখা করতে আসে।

দর্শন ওকে খাবার অফার করলে আয়ান অনিচ্ছা জানায়। ও কেমন আমতা আমতা করছে। দর্শন চুপচাপ বসে আছে কিছু বলছেও না।

" আপনি আমাকে কিছু বলার জন্য ডেকেছিলেন।"

আয়ানের কথায় ওর ধ্যান ভাঙে। 


দর্শন সোজা হয়ে বসে। তারপর গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, 

"হ্যা, তোমাদের বিয়েতে আমার কোন আপত্তি নেই। বাবা-মাকে আমি যেকোনো মূল্যে রাজি করাব। এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত থাকো। তবে আমি সে ব্যাপারে কথা বলতে আসিনি। আমার আসলে তোমার একটা হেল্প লাগবে।"


"হেল্প? কীসের হেল্প? বলুন, আমি আপনাকে কিভাবে হেল্প করতে পারি।"


"তুমি দিশাকে ভালোবাসো। আই হোপ আমার ব্যাপারও বুঝবে। আমার ভালোবাসার মানুষকে ফিরিয়ে পেতে সাহায্য করবে।"


আয়ান বিস্ময়ের চূড়ায়। বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, 

"কে সে? আর আমি কী করে হেল্প করব?"


দর্শন মৃদু হাসল। ওর চোখের কোণে খুশির ঝলক। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলতে লাগল,

"তাহলে শোন, আমি তখন কলেজে পড়ি। সিরিয়াস বয়৷ প্রেম ভালোবাসার ধারে কাছেও নেই। একটা মেয়ে আমাকে ভালোবাসত, আমাকে লুকিয়ে দেখত, ডায়েরিতে আমাকে নিয়ে মনের অব্যক্ত অনুভূতিগুলো নোট করত, কত পাগলামি করত। এক সময় আমি ওর পাগলামির প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে যাই৷ দু'জনই খুব সিরিয়াস ছিলাম। দু'জন দু'জনার মধ্যে বিভোর থাকতাম। কেয়ারিং, শেয়ারিং সব ছিল। তবে আমাদের এই ভালোবাসা অনেকের নজরে পড়ে গেল। তারপর একদিন ছোট্ট ভুল বুঝাবুঝি। ওর ভীষণ অভিমান হলো। আমি অভিমান ভাঙায় তৎপর হয়ে গেলাম। এরই মধ্যে আমি ফ্যামিলির উপর রাগ করে হঠাৎ একদিন একটা দুঃসাধ্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম। আমার অজান্তে তার লাইফেও বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল৷ সব এলোমেলো হয়ে গেল। দু'জন হারিয়ে গেলাম দু'জনের জীবন থেকে। একদম সিনেমার মতো। কিন্তু ভালোবাসাটা হারালো না। এত বছরে অনুভূতিগুলো আরো মিষ্টি আর প্রখর হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ একদিন দেখা, বুকের ভেতর দুরুদুরু অনুভূতি, চাপা আনন্দ কিন্তু সে আজো অভিমানী। সেই অভিমানী মেয়েটিকে আমি আজো পাগলের মতো চাই, যেকোন মূল্যে চাই। প্লিজ আয়ান হেল্প মি।"


আয়ান এতক্ষণ বিভোর হয়ে শুনছিল। দিশা বলেছিল ওর ভাইয়া কলেজে থাকতে একজনকে ভালোবাসত৷ এর কথাই বলেছিল? 

"তাকে কি আমি চিনি?"


দর্শন ওর কথার জবাব মুখে দিল না। মোবাইল বের করে গ্যালারি ঘেটে পুরনো কিছু ফটো বের করল। তারপর আয়ানের দিকে মোবাইল ঘুরালো। পরপর অনেকগুলো ফটো দেখাল। আয়ানের চোখে মুখে বিস্ময়। 

"অর্ষা!"


দর্শন মাথা নাড়িয়ে বলল,

"হ্যা, অর্ষা।"


আয়ান অন্য দিকে ঘুরে জোরালো শ্বাস নিয়ে বলল, 

"আমি বুঝেছি। সেদিন আপনাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার জন্যই ছুটছিল।"


দর্শন অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। চোখের কোণে পানি জমেছে। ভাঙা গলায় বলল, 

"যা হয়েছে তা আমার অজানা ছিল। জানার পরেও আমার কিছু করার ছিল না কারণ কোন কিছু বদলানোর ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেননি। তবে আমি ওকে বাকি জীবন সুখে রাখতে চাই।"


"করুণা?"


দর্শন, আয়ানের চোখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, 

"করুণা আর ভালোবাসা যেমন আলাদা দুটো শব্দ তেমনি আলাদা জিনিস। আমি ওকে কাল ভালোবাসতাম, আজ বাসি, আগামীকালও বাসব। ওকে আমি এতগুলো বছর পাগলের মতো খুঁজেছি, কষ্ট পেয়েছি, কেঁদেছি, নিজেকে একটা গন্ডির মধ্যে বেঁধে দিয়ে কেমন নিরস, নির্জীব, নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন করছি। আর তুমি বলছো করুণা?"

শেষের কথাগুলো দর্শন একটু জোরে বলল। আয়ান ওর চোখের দিকে তাকাল। লাল অশ্রুসিক্ত চোখগুলো শুধু আরেকজন প্রেমিকই পড়তে পারে। আয়ানও পেরেছে। অর্ষাও তো দর্শনকে ভালোবাসে তবে মেনে নিচ্ছে না কেন? কারণ..... ওহ নো! আয়ানের বুঝতে বাকি নেই কেন ও দর্শনকে ভালোবাসার পরেও ইগ্নোর করছে। তবে অর্ষা হ্যাপি থাকা ডিজার্ভ করে। তাই ওকে হ্যাপি করবে। দর্শনকে হেল্প করবে ও। 


আজ তাই করেছে। অর্ষাকে জোর করে নিয়ে এসেছে। দর্শনের কাছাকাছি রাখবে বলে। দর্শন ফ্রেশ হয়ে এসে বসল ওর সাথে। অর্ষা ওকে দেখে ইতস্তত করল। নড়ে-চড়ে বসে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে অন্য দিকে চেয়ে আছে। এমন ভাব করছে যেন বাড়ির প্রতিটি ইট, বালি, সিমেন্ট,  রডের হিসাব করছে। দর্শন ওর মুখের দিকে চেয়ে আলতো হাসল। 

দর্শনের মা সবাইকে ডিনার করতে ডাকল। অর্ষা যেখানটায় বসল তার ঠিক পাশে দর্শন বসল আর তার ব্যবস্থা আয়ান করল। খাওয়ার এক পর্যায়ে দর্শনের মা অর্ষাকে দেখে, ওর সম্পর্কে জেনে অর্ষার খালাকে বলল, 

"কেমন ছেলে চান ওর জন্য? আমার কলিগের একটা ছেলে আছে। আমেরিকা থাকে। আমেরিকায় স্যাটেল।"

উনার কথা শুনে সবাই খাওয়া বন্ধ করে দিল। বিশেষ করে দর্শনের। ওর নিজের মা নিজের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর প্রেমিকার বিয়ের জন্য পাত্র দেখাচ্ছে? 


অর্ষার খালা আগ্রহ নিয়ে বলল, 

"কী করে ছেলে?"

অর্ষা খালার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকাল। তারপর আয়ানের দিকে চেয়ে কি যেন ইশারা করল। 


দর্শনের মা খুশি মনে বলল,

"ডাক্তার।"


অর্ষার খালা হতাশ হলো। হতাশার সুরে বলল, 

"তাহলে তো হবে না। অর্ষার আবার ডাক্তার পছন্দ না।"

এই কথা শুনে দর্শনের গলায় খাবার আঁটকে গেল। খুকখুক করে কাশতে লাগল। সবাই ওর দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অর্ষা দ্রুত পানি এগিয়ে দিল। দর্শন ঢকঢক করে পানি খেয়ে জোরে শ্বাস নিল। 

দর্শনের মা বলল,

"বাবা,আস্তেধীরে খাও।"

দর্শন আড়চোখে অর্ষার দিকে তাকাল। তারপর বলল, 

"আপনার ডাক্তার পছন্দ না কেন?"


অর্ষা ওর প্রশ্ন শুনে বিষম খেল। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। তারপর আমতা আমতা করে বলল, 

"এমনি। এমনি পছন্দ না।"


আয়ান ওর কথার সাথে কথা জোড়ে বলল, 

"ওর ধারণা ডাক্তারটা হার্টলেস। আর হার্টলেস মানুষের সাথে জীবন কাটানো যায় না। ওর ধারণা আর কি।"

আয়ান মৃদু হাসল। ওর সাথে সবাই তাল মিলিয়ে হাসল। অর্ষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আয়ানের দিকে তাকাল।


দিশা আর আয়ানের এনগেজমেন্ট ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে। এই বাহানায় দর্শন বেশ কয়েকবার আয়ানের বাড়িতে আশা যাওয়া করেছে। নিজেরও ব্যস্ত সময় কাটছে। অল্প কিছুদিন হলো হাসপাতালে জয়েন করেছে। কাজের অনেক প্রেসার। আজও এসেছে আয়ানের বাড়িতে। এই রাতের বেলায় অর্ষা বাড়ির সামনে ছোট বাগানটাই বসে অফিসের কাজ করছে। টেবিলের উপরে কফির মগ। তাতে ধোঁয়া উড়ছে। অর্ষা কাজে এতটাই মগ্ন যে দর্শনকে খেয়াল পর্যন্ত করেনি। 

দর্শন পা টিপে টিপে ওর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসল। অর্ষার গালের উপরে আঁকাবাঁকা চুলের সামান্য গোছা বিরক্ত করতেই অর্ষা কানের পেছনে গুজে দিল। ওর চোখেমুখে ক্লান্তি। কাজের প্রেসার আর ভালো লাগছে না। মন মেজাজ বিগড়ে আছে। 

দর্শন গলা খাকাড়ি দিল,

"এহেম! এহেম!"


অর্ষা আকস্মিক আওয়াজে চমকে উঠে। ওর দিকে চকিত দৃষ্টি দিয়ে বলল, 

"এগুলো কী?"


"ভয় পেয়েছো?"


অর্ষা নিজেকে সামলে আমতা আমতা করে বলল, 

"না, প্লিজ এখন বিরক্ত করো না। আমি অলরেডি ডিস্টার্ব।"

অর্ষা ল্যাপটপের বাটনে আবারও হাত রাখল আর চোখ রাখল ল্যাপটপের স্কিনে। 

তারপর আবারও দর্শনের দিকে চেয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, 

"প্লিজ লিভ। এভাবে সব সময় ঘুরঘুর কেন করো? ভালো লাগে না। আর এসব ছ্যাচড়ামি তোমাকে মানায় না। তুমি প্লিজ তোমার মতো থাকো। আমাকে আমার মতো থাকতে দেও, বাঁচতে দেও। তুমি কি বোঝো না আমি বিরক্ত হই?"


"বিরক্ত কেন হবে? আমি কি তোমাকে বিরক্ত করেছি?"


"তাহলে কী করছো?"

অর্ষা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। 

দর্শন চুপ করে থেকে অর্ষার দিকে তাকাল। হঠাৎ ওর চোখে চোখ রাখতেই বুক ধুক করে উঠল। এই চাহুনি অর্ষার সহ্য হয় না। কেমন বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা করে।

"আমেরিকার ছেলের সাথে তোমার বিয়ের কথা আগাও। আর বিয়ে করে নেও। তাহলেই পিছু ছেড়ে দেব।"


"তোমার পিছু ছাড়াতে কাউকে বিয়ে করার প্রয়োজন পড়বে না আমার।"


দর্শন কন্ঠে কাঠিন্য এনে বলল, 

"ওহ রিয়েলি? খুব দেমাক না তোমার? আমি তোমার পেছনে ঘুরছি তোমার তো আকাশ সমান ডিমান্ড হয়ে গেছে। একদিন তুমিও আমার পেছনে ঘুরেছো এত দ্রুত কি করে মানুষ সব ভুলে যায়? আমি তো ভুলতে পারিনি। এদিকে বলছো আমেরিকার ছেলেকে বিয়ে করার প্রয়োজন নেই, ডাক্তার ছেলে পছন্দ নয় আর অন্যদিকে তোমার বাসার মানুষ আমার মায়ের কাছে দিশা আর আমার ফ্যামিলির খোঁজ খবরের চেয়ে ওই আমেরিকার ছেলের খোঁজ নিচ্ছে। ওই আমেরিকার ছেলেকে নিয়ে সমস্যা নেই। সমস্যা এই( নিজেকে উদ্দেশ্য করে) ডাক্তারকে নিয়ে। আরে সরাসরি বলো না? এমন ভাব ধরে থাকো কেন? যাও আর ওই ছেলেকে বিয়ে করে আমেরিকা স্যাটেল হয়ে যাও। তোমার স্বপ্ন কি-না।"

একে তো অর্ষার অফিসের প্রজেক্ট নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। তার উপর ওর পেছনে ওর বাসার মানুষ ওই ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছে। আর কত বুঝাবে সবাইকে? রাগ উঠে যাচ্ছে। এছাড়া দর্শন ওকে বিরক্ত করছে। মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে। অর্ষার মাথা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। 

"দর্শন, প্লিজ চলে যাও। নয়তো কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলব৷ রাগ হচ্ছে প্রচুর।"

অর্ষা চেঁচিয়ে বলল।


ওর চেয়ে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে দর্শন বলল,

"কী করবে মার্ডার করে ফেলবে? আরে বেঁচে আছি কোথায়? আমি তো বুঝতেই পারছি না আমার অন্যায়টা কোথায়। আমাকে ছাড়া বাকি সবাইকে তোমার কেন ভালো লাগে? কেন আমাকে তোমার সহ্য হয় না?"


অর্ষার হাত মুঠো করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করছে। 

দর্শন তাচ্ছিল্য হেসে বলল, 

"ওহ, আমি তো ভুলেই গেছি তুমি তো আর সেই অর্ষা নেই। সিরিয়াস মুড, ক্যারিয়ারে ফোকাস, এত বড় পোস্টে আছো। বিখ্যাত আর্কিটেক্ট। এখন দৃষ্টি থাকবে উপরের দিকে। নিচের দিকে নয়।"

দর্শন ওকে অপমান করছে। অর্ষা হাতের কফির মগটা ছুড়ে মারল। সেটা ফ্লোরে পড়ে ভেঙে গেল। ভাঙা একটা অংশ ছিটকে দর্শনের হাতের উপর গিয়ে পড়ল। এমনটা দুজনের কেউ-ই আশা করেনি। অর্ষা হতবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে। দর্শন আউচ শব্দ করে হাত ঝারা মারল। হাতে দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। অর্ষা ভয় পেয়ে গেল। আতংকিত চোখে ওর হাতের দিকে চেয়ে ডান হাতে মুখ চেপে ধরল। আর মনে মনে বলছে এটা আমি কি করলাম। দর্শন অর্ষার দিকে ব্যথিত চোখে তাকাল। অর্ষা দ্রুত গিয়ে ওর হাত চেপে ধরল। রক্ত বন্ধ করা দরকার। আশেপাশে চেয়ে কিছু না পেয়ে জামার কোণার অংশ তুলে হাতে চেপে ধরল। রক্ত কিছুটা বন্ধ হলো। 

অর্ষা অশ্রুসিক্ত চোখে অনুতাপের সুরে বলল,

"আমি ইচ্ছে করে করিনি। সরি।"


দর্শন এতক্ষণ অর্ষার দিকে চেয়ে ছিল। ওর কথার উত্তরে বলল,

"ইচ্ছে করে তো আমরা অনেকেই অনেক কিছু করি না তবুও শাস্তি পেতে হয়।"


অর্ষা ওর ইঙ্গিত বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে ওর হাতের দিকে চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

"আমি আসলেই বুঝতে পারিনি।"

ওর গাল বেয়ে পানি পড়ছে। দর্শন নির্বাক ওর গালের উপরের মুক্ত দানার উপরে মোহনীয় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

"আমি এখুনি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।"

অর্ষা তাড়া দেখাল। 


দর্শন নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বলল, 

"যে আঘাত তোমাকে কাঁদায়, তোমাকে কষ্ট দেয় সে আঘাত কেন দেও?"

অর্ষা নিরুত্তর। দ্রুত চোখের পানি মুছে নিল। দর্শন নিজের হাতের পরোয়া না করে হনহন করে হেঁটে চলে গেল। ওর গাড়ি গেটের বাইরে যেতেই অর্ষা ধপ করে বসে পড়ল। বসে বসে কাঁদতে লাগল। কান্না ছাড়া যেন জীবনে কিছুই নেই।

"আমি তোমাকে অফুরন্ত ভালোবাসা দিতে পারব কিন্তু..... আমি যে নিরুপায়।"

অর্ষা আবারও ডুকরে কেঁদে উঠল। 


সেদিনের পর থেকে দর্শনকে আর দেখেনি অর্ষা। একবারের জন্যও আয়ানদের বাড়িতে আসেনি। এনগেজমেন্টের কেনাকাটা করার সময় আসার কথা থাকলেও আসেনি। অর্ষা জানে কেন আসেনি। এভাবে দিন যেতে যেতে এনগেজমেন্টের দিন চলে এল। অর্ষা আজ মন খুলে সাজবে। শপিং মল খুঁজে খুঁজে নিজের জন্য পারফেক্ট একটা ড্রেস এনেছে৷ পার্লার থেকে সেজে এসেছে। খোলা চুলে ওকে বেশ লাগছে। এত মানুষের ভীড়ে চেনা, অতি কাঙ্খিত মুখটা দেখতে না পেয়ে ব্যথিত হলো। ও এক দিকে চায় দর্শন দূরে থাকুক কিন্তু মন মানে না। দর্শনের অনুপস্থিতি ওকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। মনের ভেতর যে দহন সৃষ্টি হয়েছে তা কেবল মাত্র দর্শনই নেভাতে পারে। অর্ষা বেশ হতাশ হলো যখন দিশার বাড়ির সবাইকে দেখার পরেও দর্শনকে দেখল না৷ এমনকি দর্শনের বন্ধুরাও এসেছে। অর্পা ওকে দেখে চমকে গেলে অর্ষা জানায় আয়ান ওর খালাতো ভাই।

হঠাৎ করে গান অফ হয়ে গেল। তারপর স্লো মিউজিক বাজতে লাগল। সবাই মিউজিক সেকশনের দিকে তাকাল। বিয়ে বাড়ি, কোন পার্টতে সাধারণ এত স্লো মিউজিক বাজে না। অর্ষা ঘুরে হঠাৎ দর্শনকে দেখল। ও হাত দিয়ে চুল ব্রাশ করছে। 

হঠাৎ বেজে উঠল ~~~~


কে তুমি? কেন এখানে? 

কেন এতদিন পরে? 

কে তুমি? কেন এখানে? 

কেন এতদিন পরে? 

তুমি কী দেবী আমার?

পেছনে ফিরে দেখো তুমি

অপ্রত্যাশিত কোন অতিথি 

চোখ ফেরালে বল কেন?

ভয় পেয়েছো, নাকি আরতি

জানি প্রতিটা স্বপ্নে তুমি দেখেছো আমায়

নিরন্তর ছিলে আমারই ছায়ায়

তবে চোখ মেলাতে কী বিরোধ? 

ভুল করে একটা বার প্রাচীরটা ভেঙে দেখো

জমে আছে কত কথা ভুল করে বলে দিও

জন্মান্তর যদি মিথ্যে হয়, এই হবে শেষ দেখা

ভালোবাসি কেন যে তোমায় হবে না কখনো বুঝা!

............


গানের ফাঁকে ফাঁকে অর্পা রুশানের দিকে তাকাচ্ছিল। রুশান অর্পাকে দেখছিল। অর্ষা মাথা নিচু করে বসে ছিল। দর্শন ওর নিচু মাথার দিকে চেয়ে অনেক কিছুই ভাবছিল। মনে হচ্ছে এই গানটা ওর জীবন গাঁথা। ওর কথাই বলছে। অর্ষা হঠাৎ বের হয়ে গেল। ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, 

"আমি কীসের শাস্তি পাচ্ছি? কেন আমাকে এত শাস্তি পেতে হচ্ছে? কেন ভালোবাসার মানুষকে সামনে পেয়েও ছুতে পারছি না বলতে পারছি না ভালোবাসি? এর চেয়ে বড় যন্ত্রণা আর কিছুতে আছে? কেন আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছো? কেন?"

অর্ষা কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়ল। অনেকটা সময় পাড় হওয়ার পারে অর্ষা মুখ ধুয়ে সবার আড়ালে বের হয়ে গেল। ও আর এক মুহুর্ত এখানে থাকতে পারছে না। ও কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়িতে চলে গেল। এদিকে দর্শন ওকে খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। ওয়াচ ম্যানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল ও চলে গেছে। দর্শন কাউকে কিছু না জানিয়ে অর্ষাকে খুঁজতে চলে গেল। অর্ষা একা বাড়িতে পৌঁছাতে পেরেছে কি-না। ওর জন্য চিন্তা হচ্ছে। 

দর্শন আয়ানের বাড়িতে গিয়ে পৌছাল। পুরো বাড়ি নীরব, নিস্তব্ধ। কাজের দুজন লোক ছিল ওরাও প্রোগ্রামে গিয়েছে। দর্শন সোজা অর্ষার রুমে চলে গেল। ওর রুমের দরজা খোলা, আলো জ্বলছিল। দর্শন ভেতরে যেতেই বিছানার উপরে ডায়েরি দেখতে পেল। আর তখনই বাথরুমের ভেতরে ওর উপস্থিতি টের পেল। বুঝতে পারছে না ডায়েরিটা ধরবে কি না। কি ভাবতে ভাবতে ডায়েরিটা তুলে পাতা উল্টাতে লাগল। একটা পাতায় ওর লেখা দুটো লাইন দেখে থমকে গেল। 



চলবে?

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url