নবজাতক শিশুর যত্ন ও সঠিক নিয়ম (০-১ মাস) | Newborn Baby Care Guide Bangla | Baby Care Tips
আসসালামু আলাইকুম!
আপনারা যারা এইমাত্র একটি নতুন নবজাতকের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছেন, আপনাদের জন্য রইল অসংখ্য অভিনন্দন! নতুন অতিথি যেমন আনন্দ নিয়ে আসে, তেমনি নতুন বাবা-মায়েদের মনে জন্ম দেয় অনেক প্রশ্ন এবং কিছুটা টেনশন। এই নিবন্ধে, আমরা নবজাতকের জন্মের প্রথম ২৮ দিনের (নিওনেটাল পিরিয়ড) সঠিক যত্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনা করব।
১. 🍼 শিশুর খাদ্য ও খাওয়ানোর নিয়ম
নবজাতকের জন্য মায়ের দুধ বা ব্রেস্ট মিল্কই প্রথম এবং প্রধান খাদ্য। প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোরই নিয়ম।
খাওয়ানোর সময়সূচী: সাধারণত প্রতি দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর বাচ্চাকে খাওয়ানো উচিত।
কোলেস্ট্রাম (Colostrum): প্রথম দুই-তিন দিনে খুব সামান্য যে দুধ আসে, তাকে কোলেস্ট্রাম বলে। এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং প্রয়োজনীয় উপাদান সমৃদ্ধ, তাই অল্প হলেও এটি খাওয়ানো খুব জরুরি। এটি একেবারে স্বাভাবিক; তিন-চার দিন পর থেকে দুধের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
বার্পিং (ঢেকুর তোলা): প্রতিবার খাওয়ানোর পর বাচ্চাকে ঢেকুর তোলা বা বার্পিং করানো অত্যন্ত জরুরি। কাঁধের উপর সোজা করে নিয়ে পিঠের উপর আলতোভাবে চাপড় দিলে সে ঢেকুর তুলতে সক্ষম হবে।
জল/পানি: কোনোভাবেই বাচ্চাকে পানি, মধু বা অন্য কিছু খাওয়ানো উচিত নয়। বরং মা খুব বেশি করে জল খাবেন, কারণ মা যত বেশি পানি পান করবেন, তার দুধের পরিমাণ তত ভালো হবে।
ফর্মুলা মিল্ক: একান্ত অপারগ হলে (যেমন: মায়ের দুধ না হলে বা মা অসুস্থ হলে) ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষে ফর্মুলা মিল্ক দেওয়া যেতে পারে, তবে এটি সাধারণত রেকমেন্ডেড নয়।
২. ✨ নবজাতকের সার্বিক যত্ন
A. চোখের যত্ন
পিছুটি: অনেক সময় চোখে পিছুটি (Mucus Discharge) হয়। পরিষ্কার, হালকা কুসুম গরম জলে ভিজিয়ে রাখা তুলো দিয়ে এক চোখ থেকে অন্য চোখে আলাদা আলাদা তুলো ব্যবহার করে পরিষ্কার করে তুলে ফেলে দিতে হবে।
কখন ডাক্তার দেখাবেন: যদি চোখ লাল হয়, ফুলে যায়, চোখ জুড়ে যায় বা পরিষ্কারের পরেও না কমে, তবে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
কাজল: শিশুকে কাজল পরাবেন না। এটি একেবারেই রেকমেন্ডেড নয়।
B. ত্বক ও ম্যাসাজ (Oil Massage)
তেল ম্যাসাজ: নাভি পড়ে যাওয়ার (সাধারণত ৭-১০ দিন) পর খুব হালকা হাতে অয়েল ম্যাসাজ বা তেল মালিশ করতে পারেন।
তেলের প্রকারভেদ: মিনারেল অয়েল, ভিটামিন অয়েল, নারিকেল তেল (Coconut Oil) বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যায়। তবে সরষের তেল ব্যবহার করা এড়িয়ে চলাই ভালো, কারণ এতে র্যাশ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
টিপ/বাইরের জিনিস: সদ্যজাত শিশুর ত্বক খুব নরম, তাই কপালে টিপ দেওয়া বা বাইরে থেকে আলাদা করে অন্য কোনো কিছু ত্বকে লাগানো উচিত নয়।
৩. 🛀 গোসল এবং পরিচ্ছন্নতা
A. গোসল
নাভি না পড়া পর্যন্ত: নাভি বা আম্বিলিক্যাল কর্ড না পড়া পর্যন্ত (সাধারণত ৭-১০ দিন) শিশুকে জল দিয়ে গোসল করানোর দরকার নেই। শুধু খাঁজগুলো (গলা, থাই) এবং শরীর পরিষ্কার রাখবেন (ওভারঅল ক্লিনিং)।
নাভি পড়ার পর: নাভি পড়ে যাওয়ার পর হালকা কুসুম গরম পানিতে গোসল করাবেন।
পরিবেশ: গোসলের সময় দরজা-জানলা বন্ধ রেখে বন্ধ ঘরে গোসল করানো ভালো। ফ্যান বন্ধ রাখবেন এবং খোলা দালানে বা ছাদে রোদে নিয়ে গিয়ে গোসল করানো এড়িয়ে চলুন।
সাবান-শ্যাম্পু: সপ্তাহে মোটামুটি দুই দিন সাবান-শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন। বাকি দিনগুলোতে শুধু জল দিয়ে পরিষ্কার করাবেন।
স্পঞ্জিং: যেদিন গোসল করালেন না, সেদিন স্পঞ্জিং বা গা মুছিয়ে দেওয়া করিয়ে নেবেন। বাচ্চাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবেই।
B. ঘরের পরিবেশ
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: বাচ্চার শোবার জায়গাটি খুব পরিষ্কার রাখুন।
মশারি: বাড়িতে উপদ্রব থাকলে অবশ্যই মশারি টাঙ্গিয়ে রাখবেন।
ঘরের তাপমাত্রা: তাপমাত্রা এমন রাখুন যাতে আপনার কাছে হালকা গরম মনে হলেও বাচ্চার জন্য তা আরামদায়ক হয়। গরমকালে এসি খুব চিল করে রাখবেন না। ঘর গরম রাখার জন্য এক্সট্রা বাল্ব জ্বালানোও রেকমেন্ডেড নয়।
C. জিভ পরিষ্কার
সাধারণভাবে জিভ আলাদা করে পরিষ্কার করার দরকার নেই।
যদি দেখেন জিভের ভেতরে দইয়ের মতো খুব মোটা স্তর (Thrush বা ফাঙ্গাল ইনফেকশন) পড়েছে, তবে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তিনি অ্যান্টিফাঙ্গাল ড্রপ দিতে পারেন।
৪. 💡 স্বাভাবিক কার্যকলাপ ও কখন ডাক্তার দেখাবেন
A. স্বাভাবিক কার্যকলাপ
পটি (পায়খানা): অনেক বাচ্চার রোজ পটি হয়, আবার অনেকে তিন-চার দিনে একবারও করতে পারে, বা দিনে তিন-চারবারও করতে পারে। এগুলো প্রতিটিই স্বাভাবিক। এটি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
ইউরিন (প্রস্রাব): দিনে অন্ততপক্ষে ৬ থেকে ৭ বার ইউরিন হওয়া দরকার। ইউরিন সঠিক হওয়াটা বেশি জরুরি।
আড়মোড়া ও হেঁচকি: বাচ্চা খুব আড়মোড়া ভাঙা (Stretching), হেঁচকি (Hiccups), বা হাঁচি দিচ্ছে, কিংবা বাতাস পাস করছে (Farting)—এগুলো সব নরমাল। এগুলো নিয়ে চিন্তা বা ওষুধের দরকার নেই।
B. ঘুমের রুটিন
ঘুমের সময়: নবজাতক দিনের বেশিরভাগ সময়ই ঘুমাবে এবং রাতের কিছুটা সময় (৩-৪ ঘণ্টা) জেগে থাকবে—এটাই তাদের নরমাল সাইকেল। প্রথম দুই-তিন মাস পর সাইকেলটি পরিবর্তন হয়ে যাবে।
খাওয়ানো: বাচ্চা ঘুমালেও তাকে কিন্তু ৩ থেকে ৩.৫ ঘণ্টার গ্যাপে গ্যাপে খাওয়ানো উচিত। গ্যাপ যেন খুব বেশি না হয়।
C. 🛌 শিশুকে শোয়ানোর নিয়ম
শিশুকে সব সময় সোজা করে শোয়াবেন (পিঠের উপর)।
কখনোই বাচ্চাকে পাশ ফিরিয়ে (Side) বা উপর হয়ে (Face down) শোয়াবেন না। এটি ক্ষতিকারক হতে পারে এবং খারাপ ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
মাথাটা মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক ঘোরানো যেতে পারে।
D. 🩺 কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন (জরুরি সতর্কতা)
জন্মের ৭-১০ দিন নাগাদ একবার ফলোআপের জন্য ডাক্তারের সাথে দেখা করা খুব জরুরি (ওজন, জন্ডিস পরীক্ষা ও অন্যান্য প্রশ্ন আলোচনা করার জন্য)।
এছাড়াও, যদি নিম্নলিখিত বিষয়গুলি দেখেন, তবে অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখাবেন:
বাচ্চা একদম প্রস্রাব করছে না বা খুব কম প্রস্রাব হচ্ছে।
সে একদম খাচ্ছে না বা খুবই কম খাচ্ছে।
বাচ্চা নেতিয়ে আছে (Lethargic), তাকে ডেকে তোলা যাচ্ছে না।
জন্ডিস হয়েছে—বাচ্চার গা একদম হলুদ হয়ে গেছে।
জিভে খুব মোটা স্বর (Thrush) পড়েছে।
এছাড়া অন্য যা কিছু আপনার অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
E. 💉 টিকাকরণ (Vaccination)
জন্মের সময় বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কিছু ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।
পরবর্তী ভ্যাকসিন দেড় মাস থেকে শুরু হবে।
আপনার শিশু জন্মের সময়কার ভ্যাকসিনগুলি পেয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে শীঘ্রই আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
আশা করি এই তথ্যগুলো নতুন মা-বাবা হিসেবে আপনাদের উপকার করবে । তথ্যগুলো ভালো লাগলে লাইক দিন এবং নতুন মা-বাবাদের সাথে শেয়ার করুন ।
নবজাতক নিয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানান, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব । এমন আরও তথ্য পেতে আমাদের চ্যানেলটি Subscribe করে বেল আইকনটি বাজিয়ে দিন । দেখা হবে পরের কোন পোস্টে, ততক্ষণ সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন—আল্লাহ হাফেজ ।
মনের রঙের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url