ব্যর্থতা থেকে সফলতার অলৌকিক গল্প | Best Motivational Story Bangla
অর্ণব ছিল একটি মফস্বল শহরের সাধারণ ছেলে। তার স্বপ্নটা ছিল একটু অদ্ভুত। সে চাইত এমন এক ধরনের মৃৎশিল্প বা পটারি (Pottery) তৈরি করতে, যা আধুনিক এবং ঐতিহ্যের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ হবে। তার ইচ্ছা ছিল, সে মাটির তৈরি জিনিসকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাবে যা কাঁচের চেয়েও স্বচ্ছ এবং পাথরের চেয়েও শক্ত মনে হবে।
কিন্তু সমস্যা হলো, অর্ণবের আশেপাশের মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। তার বন্ধুরা যখন বিসিএস বা ব্যাংকের চাকরির জন্য দিনরাত লাইব্রেরিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকত, অর্ণব তখন কাদামাটি মেখে পড়ে থাকত তার ছোট গ্যারেজে।
মানুষ বলত, "মাটির কাজ করে কেউ বড় হতে পারে না। তুই জীবনে কিছুই করতে পারবি না।"
অর্ণব চুপ করে শুনত। তার মনে হতো, "মানুষের কথায় কান দেওয়া মানে নিজের স্বপ্নের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা।" সে বিশ্বাস করত, তার কাজের মধ্যে এমন এক 'ইউনিকনেস' আছে যা একদিন পৃথিবী দেখবে।
দুই বছর কেটে গেল। অর্ণব তার জমানো সব টাকা দিয়ে একটি বিশেষ চুলা (Kiln) তৈরি করল। তার লক্ষ্য ছিল 'নীলকান্ত' নামে একটি বিশেষ ভাজ (Vase) তৈরি করা, যার রং হবে আকাশের মতো গভীর নীল, কিন্তু টেক্সচার হবে মাটির।
প্রথমবার যখন সে ভাজটি আগুনে দিল, সেটি ফেটে গেল। দ্বিতীয়বার, রং ঠিকমতো এল না। তৃতীয়বার, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভুল হলো এবং পুরো লট নষ্ট হয়ে গেল।
এইভাবে প্রায় ৫০ বার চেষ্টা করার পর, অর্ণবের টাকা শেষ হয়ে গেল। তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিলেন। প্রেমিকা তাকে ছেড়ে চলে গেল এই বলে যে, "তোমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।"
এই মুহূর্তটি ছিল অর্ণবের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়। ব্যর্থতা (Failure) যেন তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছিল। সে নিজেকে প্রশ্ন করল, "আমি কি ভুল পথে আছি? আমার কি ছেড়ে দেওয়া উচিত?"
হতাশ অর্ণব একদিন নদীর পাড়ে বসে ছিল। সেখানে এক বৃদ্ধ মাঝি নৌকা মেরামত করছিলেন। মাঝির নৌকাটি ছিল অনেক পুরোনো, অজস্র তালি দেওয়া। অর্ণব মাঝিকে জিজ্ঞেস করল, "চাচা, এই ভাঙা নৌকা নিয়ে আপনি নদীতে নামতে ভয় পান না?"
মাঝি হাসলেন। বললেন, "বাবা, নৌকা ডোবে না তালি থাকার কারণে, নৌকা ডোবে যদি মাঝির মনের জোর না থাকে। আমি যখন এই নৌকাটা মেরামত করি, তখন আমি শুধু কাঠ জোড়া দিই না, আমি আমার বিশ্বাসকেও জোড়া দিই। যতক্ষণ আমি বিশ্বাস করি এই নৌকা ভাসবে, ততক্ষণ নদীও আমাকে সম্মান করে।"
এই কথাটি অর্ণবের মাথায় বজ্রপাতের মতো আঘাত করল। সে বুঝতে পারল, তার মাটির পাত্রগুলো ফেটে যাচ্ছিল কারণ সে সেগুলোকে নিখুঁত করার জন্য অতিরিক্ত সতর্ক ছিল, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে তার 'আত্মবিশ্বাস' ছিল না। সে শুধু সফল হওয়ার জন্য কাজ করছিল, কাজটাকে ভালোবেসে নয়।
অর্ণব ফিরে এল। কিন্তু এবার সে তার কৌশল বদলাল। সে আর কাউকে দেখানোর জন্য কাজ শুরু করল না। সে নিজেকে সম্পূর্ণ আইসোলেটেড (Isolated) করে ফেলল।
সে ভাবল, "আগুনকে আমি ভয় পাব না, আগুনকে আমি বন্ধু বানাব।"
অর্ণব বুঝতে পারল, মাটির পাত্র পোড়ানোর সময় আগুনের তাপমাত্রা নয়, বরং আগুনের 'স্থিতিশীলতা' বা Consistency আসল। সে তার শেষ সম্বল, তার বাইকটি বিক্রি করে দিল নতুন করে কাঁচামাল কেনার জন্য।
শুরু হলো তার কঠোর পরিশ্রম (Hard Work) । টানা ২১ দিন সে গ্যারেজ থেকে বের হলো না। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই, চোখের নিচে কালি। সে মাটির সাথে কথা বলত। সে আগুনের সাথে কথা বলত।
সেবারের প্রচেষ্টায় সে মাটি তৈরি করার সময় তাতে নিজের ঘাম আর চোখের জল—দুটোই মিশিয়েছিল রূপক অর্থে। সে আর ফলাফলের আশা করছিল না, সে শুধু প্রক্রিয়াটিকে (Process) উপভোগ করছিল।
২১তম দিনের মাথায়, ভাটা খোলার সময় হলো। অর্ণবের হাত কাঁপছিল। সে ধীরে ধীরে চুলার দরজা খুলল।
ভিতর থেকে বের হয়ে আসা তাপের সাথে এক অদ্ভুত আভা বেরিয়ে এল। অর্ণব দেখল, তার তৈরি ভাজটি অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। আর তার রং? সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য! আকাশের নীল আর সমুদ্রের গভীরতা যেন সেখানে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এটি সাধারণ কোনো শোপিস ছিল না, এটি ছিল জীবন্ত এক শিল্পকর্ম।
সেদিন অর্ণব বুঝতে পেরেছিল, "সফলতা কোনো গন্তব্য নয়, এটি আগুনের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সাহস।"
আজ অর্ণবের তৈরি সেই 'নীলকান্ত' সিরিজের ভাজগুলো ইউরোপের বড় বড় মিউজিয়ামে শোভা পায়। যে বন্ধুরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, তারা আজ তার অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য অপেক্ষা করে। অর্ণব এখন শুধু একজন শিল্পী নয়, সে একজন সফল উদ্যোক্তা।
কিন্তু অর্ণব কি বলে জানেন? সে বলে, "আমার সফলতা ঐ ভাজগুলো নয়। আমার সফলতা হলো সেই রাতগুলো, যখন আমার পকেটে টাকা ছিল না, পেটে ক্ষুধা ছিল, কিন্তু বুকে আশা ছিল।"
এই গল্প থেকে আমরা কী শিখলাম?
প্রিয় পাঠক/শ্রোতা, অর্ণবের এই সফলতার গল্প (Success Story) আমাদের জীবনের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়:
ধৈর্যই হলো আসল শক্তি: অর্ণব যদি ৫০ বার ব্যর্থ হওয়ার পর থেমে যেত, তবে আমরা আজকের অর্ণবকে পেতাম না। ধৈর্য (Patience) মানে শুধু অপেক্ষা করা নয়, অপেক্ষার সময় নিজের মানসিকতা ঠিক রাখা।
ব্যর্থতাই সফলতার ভিত্তি: প্রতিটি ব্যর্থ ভাজ অর্ণবকে শিখিয়েছিল কী করা যাবে না। আপনার জীবনের ব্যর্থতাগুলো আবর্জনা নয়, সেগুলো আপনার অভিজ্ঞতার সিঁড়ি।
মানুষের কথায় কান না দেওয়া: সমাজ আপনাকে বিচার করবে আপনার বর্তমান অবস্থা দেখে, কিন্তু একমাত্র আপনি জানেন আপনার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কতটুকু।
আপনার স্বপ্ন যত বড় হবে, আপনার পরীক্ষা তত কঠিন হবে। আপনি যদি এখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তবে মনে রাখবেন—সৃষ্টিকর্তা আপনাকে ভাঙছেন না, তিনি আপনাকে গড়ছেন। অর্ণবের মতো আপনার জীবনেও সেই 'নীলকান্ত' মুহূর্তটি আসবে, যদি আপনি ময়দান ছেড়ে না যান।
নিজেকে বিশ্বাস করুন। শুরু করুন শূন্য থেকে, আর হয়ে উঠুন আপনার নিজের গল্পের নায়ক।
মনের রঙের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url